এবং ৪।৫ বৎসর ধরিয়া প্রতি ছেলের জন্য মাসিক ৪৫।৫০৲ টাকা ব্যয় করেন। যাঁহারা কলিকাতায় ছেলে পাঠাইতে পারেন না, স্থানীয় কলেজে ছেলে পাঠান! এই সব যুবকেরা লেখাপড়া শেষ করিয়া যখন জীবন সংগ্রামে প্রবেশ করে, তখন চারিদিকে অন্ধকার দেখে। উপায়ান্তর না দেখিয়া হয় তাহারা বেকার উকীল অথবা সামান্য বেতনের শিক্ষক বা কেরাণী হয়। আমি বহুবার বলিয়াছি যে, ঐ সব জমিদার ও উকীলেরা যদি বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কৃষি কার্যের উন্নতির দিকে মনোযোগ দিতেন অথবা কৃষিজাত পণ্যের ব্যবসা করিতেন, তাহা হইলে তাঁহারা ও তাঁহাদের সন্তানেরা নিজেদের জেলায় ও গ্রামে থাকিয়াই লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিতে পারিতেন। তামাক বা পাটের মরসুম বৎসরের মধ্যে তিন মাসের বেশী থাকে না, অবশিষ্ট কয়েক মাস তাঁহারা লেখাপড়া, কৃষিকার্য এবং অন্যান্য কাজ করিতে পারিতেন।
ইংলণ্ডের অভিজাতদের জ্যেষ্ঠ পুত্রেরাই ‘জ্যেষ্ঠাধিকার আইন’ অনুসারে পৈতৃক সম্পত্তির উত্তরাধিকারী, কনিষ্ঠ পুত্রেরা সাইরেনসেণ্টার বা অন্যান্য স্থানের কৃষিকলেজে পড়িতে যায় এবং সেখানে কৃষিবিদ্যা শিখিয়া অস্ট্রেলিয়া অথবা কানাডায় গিয়া ধনী কৃষক হইয়া বসে। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত লোকেরা হাত পা চোখ নিজেরাই যেন বাঁধিয়া ফেলিয়াছেন এবং ধাঁধা রাস্তা ছাড়া অন্য কোন পথে চলিতে পারেন না। তাঁহাদের একথা কখনই মনে হয় না যে, ভাল সার ও বীজ প্রয়োগ করিয়া বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে কৃষিকার্যের দ্বারা, চাষের উন্নতি ও উৎকৃষ্ট ফসল উৎপন্ন করা যায়। সুতরাং তাঁহারা গতানুগতিক ভাবেই চলিতে থাকেন এবং আবহমান কাল হইতে যে ভাবে চাষ হইতেছে, তাহাই হইয়া থাকে।
রংপুরে বুড়ীহাটে একটি সরকারী তামাকের ফার্ম আছে এবং সেখানে ভাল জাতের তামাকের চাষ হয়—জমিতে যথাযোগ্য সার প্রভৃতিও দেওয়া হয়। কৃষি বিভাগের ভূতপূর্ব সাপারিন্টেণ্ডেণ্ট রায় সাহেব যামিনীকুমার বিশ্বাসের তত্ত্বাবধানে উৎপন্ন বুড়ীহাট ফার্মের তামাক অতিশয় প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। ‘তামাকের চাষ’ গ্রন্থে তিনি তাঁহার অভিজ্ঞতা ও গবেষণা বিশদ ভাবে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, স্থানীয় জমিদারদের ছেলেরা এই সুযোগ গ্রহণ করা আবশ্যক মনে করে না। সরকারী তামাকের ফার্মের সুপারিন্টেণ্ডেণ্টের নিকট পত্র লিখিয়া আমি যে উত্তর পাইয়াছি, তাহাতেও এই কথা সমর্থিত হয়;—“আমি দুঃখের সঙ্গে আপনাকে জানাইতেছি যে—ভদ্রলোকের ছেলেরা উন্নত প্রণালীর তামাকের চাষ শিখিবার জন্য আজকাল এখানে খুব কমই আসে।” বাঙালী যুবকদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির মোহে এতদূর অধঃপতন হইয়াছে যে, তাহাদের ঘরের কাছে যে সব সুযোগ সুবিধা আছে, তাহাও তাহারা গ্রহণ করিতে পারে না। এ কথা ভাবিয়া আমার হৃদয় বিদীর্ণ হয়।
আমি দেখিতেছি, প্রতি বৎসর নূতন নূতন রেলপথ খোলা হইতেছে, কিন্তু ইহার ঠিকাদারীর কাজ সমস্তই কচ্ছী[১], গুজরাটী এবং পাঞ্জাবীরা একচেটিয়া করিয়া
- ↑ দৃষ্টান্ত স্বরূপ শ্রীযুত জগমল রাজার নাম করা যায়। ইনি কচ্ছদেশবাসী, এবং বালী ব্রিজের ঠিকাদারী লইয়াছিলেন। কয়েকটি কয়লার খনির কয়লা তুলিবার ঠিকাদারীও ইনি লইয়াছেন। শ্রীযুত রাজা এলাহাবাদের একজন বড় ব্যবসায়ী। সেখানে তাঁহার একটি কাচের কারখানা আছে। আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুসারে যে ব্যক্তি অর্দ্ধশিক্ষিত বলিলেও হয়, তিনি একাকী ভারতের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত এতগুলি বিভিন্ন রকমের ব্যবসা কিরূপে পরিচালনা করেন, তাহা সাধারণ উপাধিমোহগ্রস্ত বাঙালীর নিকট দুর্বোধ্য প্রহেলিকা মনে হইতে পারে।
আমি নিজে অনুসন্ধান করিয়াও জানিতে পারিয়াছি। জমিরুদ্দীনের মত অসংখ্য দালাল আছে। তাহারা সাধারণ গ্রাজুয়েটদের চেয়ে প্রায় ৪ গুণ বেশী উপার্জন করে। এবং সামান্য চাকরীর লোভে বাড়ী ছাড়িয়া তাহাদের বিদেশে যাইতে হয় না।