পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০৬
আত্মচরিত

তুলনা করিলে বাঙালীরা দক্ষতা ও পরিশ্রমপটুতায় হিন্দুস্থানীদের নিকট দাঁড়াইতে পারে না, হিন্দস্থানীরা আবার চীনাদের নিকট দাঁড়াইতে পারে না।[] বাঙালী মিস্ত্রী ও চীনা মিস্ত্রীদের সঙ্গে তুলনা করিলে, উভয়ের মধ্যে বিস্তর প্রভেদ দেখা যাইবে, যদিও তাহারা সমাজের একই স্তরের লোক এবং উভয়েই অশিক্ষিত। চীনা মিস্ত্রীরা ধীরে ধীরে কলিকাতায় প্রভাব বিস্তার করিয়াছে এবং রেলওয়ে ও P. W. D. হইতে ঠিকাদারী লইতেছে। তাহারা নিজের কারখানা স্থাপন করে, কিন্তু বাঙালী মিস্ত্রীরা (তাহাদের মধ্যে অনেকে মুসলমান) দিন মজুরী পাইয়াই সন্তুষ্ট এবং স্বীয় অবস্থার উন্নতি সাধনের জন্য কোন চেষ্টা করে না। একথা সকলেই জানে যে, বাঙালী মিস্ত্রীরা যে মুহূর্তে বুঝিতে পারে যে, তাহাদের কাজ তদারক করিবার জন্য কেহ নাই, সেই মুহূর্তেই তাহারা কাজে ঢিলা দিতে আরম্ভ করে। তাহাদের এই কদভ্যাস একরূপ প্রবাদ বাক্যের মধ্যে দাঁড়াইয়াছে।

 হিন্দুস্থানীরা বাঙালীদের চেয়ে বেশী কর্মঠ, কিন্তু চীনারা ইহাদের সকলের চেয়ে কর্মঠ; তা ছাড়া, চীনারা বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন। কোন চীনা কখনও তাহার কর্তব্যে অবহেলা করে না। তাহার প্রভুর নজর তাহার কাজের উপর থাকুক আর না-ই থাকুক, তাহাতে কিছু আসে যায় না। সে বেশী মজুরী নেয় সত্য, কিন্তু প্রতিদানে ভাল কাজ করে এবং বেশী কাজ করে। আর একটি প্রভেদ এই যে, বাঙালী বা হিন্দুস্থানী শ্রমশিল্পীর উন্নতির জন্য কোন চেষ্টা নাই, সে তাহার চিরাচরিত পথে চলে, যন্ত্রচালিতের মত কাজ করে। কিন্তু একজন চীনা যে কেবল ভাল কাজ করে, তাহাই নয়, কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবাইয়া দেয় এবং উহাতে গর্ব বোধ করে। দিনের পর দিন সে তাহার কাজে উন্নতি করে, যতদূর সম্ভব তাহার কাজে কোন ত্রুটী হইতে সে দেয় না। দুর্ভাগ্যক্রমে তাহার চরিত্রে নানা দোষও আছে। আফিং খাওয়ার অভ্যাস সে ক্রমে ত্যাগ করিতেছে বটে, কিন্তু সে এখনও জুয়া খেলায় অত্যন্ত আসক্ত। কিন্তু চীনারা অশিক্ষিত হইলেও বেশী কৌশলী অধ্যবসায়ী। রেঙ্গুন, মালয় উপনিবেশ এবং আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে তাহারা নিজেদের বসতি বিস্তার করিয়াছে। পারি, আমস্টার্ডাম এবং ম্যান্‌চেষ্টারেও চীনাদের দেখা যায়। সেখানে তাহারা দোকানদার, শ্রমিক ইত্যাদি রূপে জীবিকা নির্বাহ করে। বস্তুতঃ, চীনারা হিমশীতল মেরু প্রদেশেই হোক আর রৌদ্রতপ্ত গ্রীষ্মপ্রধান দেশেই হোক, যে কোন জল বায়ুর মধ্যে টিকিয়া থাকিতে পারে। পক্ষান্তরে, বাঙালী শ্রমশিল্পীদের অধ্যবসায় নাই; এই পরিবর্তনশীল যুগে বিচিত্র অবস্থার সঙ্গে সে সামঞ্জস্য স্থাপন করিতে পারে না। সে অনাহারে মরিবে, তবু পৈতৃক বাসস্থান ত্যাগ করিবে না। পূর্ব বঙ্গের মুসলমানেরা জাতিগত কুসংস্কার না থাকার দরুণ, অধিকতর সাহসী ও অধ্যবসায়শীল। নদী বক্ষের ষ্টীমারে তাহারাই সারেঙ এবং লস্করের কাজ করে। ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান, পি এণ্ড ও কোং এবং অন্যান্য কোম্পানীর সমুদ্রগামী জাহাজেও তাহারাই প্রধানতঃ লস্করের কাজ করে। তাহারা অনেক সময়ে জনবহুল পৈতৃক বাসস্থান ত্যাগ করিয়া পদ্মার চরে


  1. কলিকাতায় পূর্বে হিন্দু ছুতার মিস্ত্রীদেরই প্রাধান্য ছিল, কিন্তু আধুনিক কালে মিস্ত্রীদের ছেলেরা স্ব-ব্যবসারে প্রবেশ করিতে অনিচ্ছুক এবং কেরাণীর কাজ পাইবার জন্য ব্যগ্র হওয়াতে, হিন্দু মিস্ত্রীদের স্থান চীনা ও এদেশীর মুসলমান মিস্ত্রীরা দখল করিতেছে।... ভারতীয় মিস্ত্রীদের প্রধান দোষ, তাহারা সঠিক মাপজোঁক করিতে অনিচ্ছুক, যন্ত্রপাতি ভাল আছে কি না, তাহা দেখে না এবং তাহাদের সময়-জ্ঞানের অত্যন্ত অভাব। এ দেশের প্রচলিত প্রবাদেও ছুতার মিস্ত্রীদের এই সময়-জ্ঞানের অভাবের প্রতি কটাক্ষ আছে।—Cumming: Review of the Industrial Position and Prospects of Bengal in 1908, p. 16.