পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩০৭

অথবা আসামের জঙ্গলে যাইয়া বসতি করে এবং সেখানে তাহারা প্রচুর ধান ও পাট উৎপন্ন করে। তৎসত্ত্বেও তাহারা চীনাদের সঙ্গে তো দূরের কথা, উত্তর ভারত হইতে আগত হিন্দুস্থানীদের সহিতও প্রতিযোগিতায় টিকিতে পারে না।

 কলিকাতায় ছোট ছোট চামড়ার কারখানা এবং জুতার দোকান সমস্তই চীনা, জাঠ মুসলমান এবং হিন্দুস্থানী চামারদের হস্তগত। নিম্নোদ্ধৃত বিবরণটি হইতে আমার উক্তির সত্যতা বুঝা যাইবে:—

 “কলিকাতায় চীনাদের প্রায় ২৫০ শত জুতার দোকান আছে, উহারা সকলে মিলিয়া প্রায় ৮।১০ হাজার মুচীকে কাজে খাটায়। প্রচলিত প্রথা এই যে, জুতার উপরের অংশ চীনারা তৈরী করে এবং সুকতলা ও গোড়ালি মুচীরা সেলাই করিয়া দেয়। এই কাজে মুচীদের মজুরী সাধারণতঃ দৈনিক ৸৹ আনা হইতে ৸৵৹ আনা। বেশী কারিগরির কাজ হইলে মজুরী এক টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়।” The Statesman, Oct., 1930.

 মুচীদের সংখ্যা যদি গড়ে ৯ হাজার এবং প্রত্যেকের মজুরী দৈনিক তের আনা ধরা যায়, তাহা হইলে মুচীদের আয় বৎসরে ২৬ লক্ষ টাকা দাঁড়ায়। হিন্দুস্থানীদের জুতার দোকানে আরও কয়েক হাজার মুচী নিজেরা জুতা নির্মাণের ব্যবস্থা করে; এবং পূর্বোক্ত হারে তাহারাও বৎসরে প্রায় ২৬ লক্ষ টাকা উপার্জন করে। সুতরাং কথাটা অবিশ্বাস্য মনে হইলেও, ইহা সত্য যে, অবাঙালী মুচীরা এই বাংলা দেশে বসিয়া বৎসরে ৫২ লক্ষ টাকা অথবা অর্দ্ধ কোটী টাকার অধিক উপার্জন করে।

 ঢাকা সহরের নিকটে যে সব চামার বাস করে, তাহাদের ব্যবসা নাই, সুতরাং তাহারা অনশনক্লিষ্ট জীবন যাপন করে। বাংলার অনুন্নত জাতিদের মধ্যে তাহারাই সর্বাপেক্ষা দরিদ্র ও নিপীড়িত। তাহারা জীবিকার জন্য ভিক্ষা করিতে লজ্জা বোধ করে না। যদি তাহারা জুতা মেরামত বা জুতা সেলাইয়ের কাজও করিত, তাহা হইলেও দৈনিক বার আনা এক টাকা উপার্জন করিতে পারিত। কিন্তু এই কাজ হিন্দুস্থানী বা বিহারী চামারেরা দখন করিয়া লইয়াছে। অবশ্য এই কর্মে অপ্রবৃত্তিই ঢাকার চামারদের এই দুর্দশার কারণ। শ্রীরামপুরের বিখ্যাত পাদরী কেরী সাহেব একথা বলিতে লজ্জা বোধ করিতেন না যে, তিনি এক সময়ে চর্মকারের কাজ করিতেন; লেনিনের পদাধিকারী স্ট্যালিন তাঁহার দারিদ্র্যের দিনে মুচীর কাজ করিতেন। কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থার আগাগোড়া একটা কাল্পনিক গর্বে আচ্ছন্ন।

 একজন শিক্ষিত অধ্যবসায়শীল বাঙালী সরকারী রিসার্চ ট্যানারীতে তিন বৎসর শিক্ষা লাভ করিয়া জুতার ব্যবসা আরম্ভ করিয়াছেন। তিনি সাধারণতঃ তাঁহার কারখানাতে দশ জন হিন্দুস্থানী চামার নিযুক্ত করেন, উহারা দিন ১০।১২ ঘণ্টা কাজ করিয়া প্রত্যহ গড়ে এক জোড়া করিয়া জুতা তৈরী করে। তাহাদের আয় দৈনিক গড়ে ১৷৷৵৹ অথবা মাসে ৫০ টাকা। বাঙালী যুবকটি আমাকে বলিয়াছিল যে, একজন চীনা মুচী যদিও মাসিক এক শত টাকার কমে কাজ করিতে রাজী হইবে না, তবুও তাহার দ্বারা কাজ করানো শেষ পর্যন্ত লাভজনক। কেননা সে বেশী পরিশ্রম করে এবং তাহার কাজও ভাল হয়। চীনারা মৌমাছিদের মত পরিশ্রমী। তাহারা দিনের প্রত্যেকটি মুহূর্ত কাজে লাগায়, এক মিনিট সময়ও নষ্ট করে না। তাহাদের মেয়েরাও সমান পরিশ্রমী, এবং বাঙালী মেয়েদের মত তাহারা দিবানিদ্রায় সময় নষ্ট করে না। দোকানের পিছনে নিজেদের বাড়ীতে তাহারা হয় কাপড় কাচায় ব্যস্ত অথবা জামা সেলাই করে। হিসাব করিয়া দেখা গিয়াছে যে, কলিকাতায় চীনারা জুতা ও চামড়ার ব্যবসায়ে বৎসরে প্রায় এক কোটী টাকারও বেশী উপার্জন করে। তা ছাড়া, চীনা ছুতারেরাও বৎসরে কয়েক লক্ষ টাকা উপার্জন করে।