পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৪২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩০৮
আত্মচরিত

(৫) অধ্যবসায় ও উদ্যামের অভাব ব্যর্থতার কারণ

 আমি যখন প্রথম কলিকাতায় আসি, তখন সমস্ত মশলা ব্যবসায়ীরা বাঙালী ছিল। এখন গুজরাটীরা এই ব্যবসায় বাঙালীদের হাত হইতে কাড়িয়া লইয়াছে।[] আর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়, প্রথম যখন ব্রিটিশ পণ্য বর্জন আরম্ভ হয়, তখন স্বদেশী সিগারেট বা বিড়ির প্রচলন হয়। তখন কলিকাতায় বহু ভবঘুরে এই বিড়ির ব্যবসা করিয়া সাধু উপায়ে দুই পয়সা উপার্জন করিত। কিন্তু সমাজের নিম্ন স্তরের লোকেরাই, যথা, গাড়োয়ান, ছ্যাকড়া গাড়ীওয়ালা, কুলী প্রভৃতি সাধারণতঃ বিড়ি খাইত। উচ্চ স্তরের লোকেরা বিড়ি পছন্দ করিত না। গুজরাতীরা সর্বদা নূতন সুযোগের সন্ধানে থাকে, তাহারা চট করিয়া বুঝিতে পারিল যে, যেখানে বিড়ির পাতা পাওয়া যায় এবং শ্রমের মূল্য কম, সেই স্থানে যদি বৃহৎ আকারে বিড়ির ব্যবসা ফাঁদা যায়, তবে খুব ভাল ব্যবসা চলিবে। তদনুসারে তাহারা মধ্যপ্রদেশকে কার্যক্ষেত্র করিয়া লইল। বি, এন, রেলওয়ে এই কাজের উপযুক্ত স্থান। এখানে জমি শুষ্ক অনুর্বর, অধিবাসীদের জীবিকা সংগ্রহ করিতে বেগ পাইতে হয়, কাজেই মজুরী খুব কম। তা ছাড়া ঐ স্থানের বনে শাল ও কেন্দুয়া গাছ আছে, উহার পাতায় মোড়ক ভাল হয়। বোম্বাই অঞ্চল হইতে তামাক আমদানী করা হয়। কিন্তু গণ্ডিয়া কলিকাতা বা লাহোরের চেয়ে বোম্বাইয়ের বেশী কাছে, সুতরাং তামাক পাতা আনিতে রেলের মাশুল কম পড়ে। এই বিড়ি তৈরীর ব্যবসা সম্পূর্ণরূপেই কুটীর শিল্প, কোন কল ইহাতে ব্যবহৃত হয় না। বড় বড় বিড়ির ফার্ম ও আছে, ১৯২৬ সালে ইহার একটি আমি পরিদর্শন করি। এগুলি কেবল বিড়ি পাতার এবং তৈরী বিড়ি সংগ্রহের গুদাম। এইরূপে একটি বৃহৎ ব্যবসা গড়িয়া উঠিয়াছে এবং ইহার দ্বারা প্রায় ৫০ হাজার লোকের অন্ন সংস্থান হইতেছে। কারখানা হইতে বৎসরে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা মূল্যের বিড়ি তৈরী হইতেছে। আধুনিক স্বদেশী আন্দোলনের ফলে এই ব্যবসায়ের জোর হইয়াছে, কেননা অন্ততঃপক্ষে বাংলাদেশে সর্বশ্রেণীর লোক বিড়ি খাওয়া আরম্ভ করিয়াছে এবং বিড়ির ব্যবসায়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লাভ হইতেছে।[]


  1. বাংলায় ‘গন্ধবণিক’ শব্দের অর্থ মশলা ব্যবসায়ী—এ পর্যন্ত এ ব্যবসা তাহাদেরই একচেটিয়া ছিল।
     আমি নিম্নে কয়েকজন প্রসিদ্ধ মশলা ব্যবসায়ীর নাম করিতেছি:—আর্মেনিয়ান স্ট্রীট—রামচন্দ্র রামরিচ পাল, জানকীদাস জগন্নাথ, রাউথমল কানাইয়ালাল। আমড়াতলা স্ট্রীট—রতনজী জীবনদাস, রামলাল হনুমান দাস, গোপীরাম যুগলকিশোর, শুকদেও জহরমল, এন. জগতচাঁদ, জগন্নাথ মতিলাল, যশোরাম হীরানন্দ, সুরজমল সতুলাল, তার মহম্মদ জালু, দৌজী দাদাভাই হোসেন কাসেম দাদা, হাজী আলি মহম্মদ আলি শা মহম্মদ, মতিচাঁদ দেওকরন। সতেরাং দেখা যাইতেছে যে, বাঙালী তাহার বংশান, ক্রমিক ব্যবসা হইতে বহিষ্কৃত হইয়াছে।
  2. বিড়ি ব্যবসায়ের প্রয়োজনীয়তা ইহা হইতেই বুঝা যাইবে যে, ১৯২৮—২৯ সালে প্রায় দুই কোটী টাকা মূল্যের বিদেশী সিগারেট আমদানী হইয়াছিল। স্বদেশী আন্দোলনের ফলে সিগারেটের পরিবর্তে লোকে বিড়ি ব্যবহার করাতে, বিড়ি ব্যবসায়ে খুব লাভ হইতেছে। কাঁচা মাল সরবরাহের ব্যবসাও বেশ জাঁকিয়া উঠিয়াছে; এক শ্রেণীর চূর্ণ তামাক এবং কেন্দুয়া গাছের পাতাই ইহার কাঁচা মাল। যাহারা বিড়ি এবং তৎসম্পর্কীর কাঁচা মালের ব্যবসা করে, এরূপ কয়েকটি প্রধান ফার্মের নাম দেওয়া গেল:—
     মুলজী সিরা এণ্ড কোং, এজরা স্ট্রীট; ভোলা মিঞা, ক্যানিং স্ট্রীট; চুণিলাল পুরুষোত্তম, চিৎপুর রোড; কালিদাস ঠাকুরসী, আমড়াতলা স্ট্রীট; ভাইলাল ভিকাভাই, আমড়াতলা স্ট্রীট; মণিলাল আনন্দজী, হ্যারিসন রোড; সতীশচন্দ্র চন্দ্র, হ্যারিসন রোড।
     দেখা যাইতেছে, বিড়ি ব্যবসায়ে মাত্র একটি প্রধান বাঙালী ফার্ম আছে। অধিকাংশ বিড়ির কারখানাই মধ্যপ্রদেশে বি. এন. রেলওয়ে লাইনের ধারে—সম্বলপুর, বিলাসপুর, চম্পা, হেমগিরি,