বাংলাদেশে আগত মাড়োয়ারী বা অবাঙালী তাহার ব্যবসার প্রথম অবস্থায় সামান্য ভাবে জীবন যাপন করে, সে যতদূর সম্ভব কম ব্যয়ে জীবন ধারণ করে। সে কায়িক পরিশ্রম করিতে সর্বদা প্রস্তুত এবং সকাল হইতে রাত্রি দশটা পর্যন্ত ক্রমাগত পরিশ্রম করে এবং ইহার ফলে সে দেশীয় ব্যবসায়ীদের অপেক্ষা সস্তায় জিনিষ বিক্রয় করিয়া প্রতিযোগিতায় তাহাদের পরাস্ত করিতে পারে। আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এসিয়াবাসীদের বিরুদ্ধে কেন নানারূপ কঠোর আইন করিয়াছে, তাহা এখন বুঝা শক্ত নহে। ‘জন চীনাম্যান, এক মুষ্টি অন্ন খাইয়া থাকে, মদ্য পানও করে না, সুতরাং কম মজুরীতে কাজ করিয়া তাহার শ্বেতাঙ্গ সহকর্মীদের সে প্রবল প্রতিযোগী হইয়া দাঁড়ায়। হকার বা ছোট ব্যবসায়ীদের কাজে সে অল্প লাভে জিনিষ বিক্রয় করিতে পারে।’ বস্তুতঃ, এসিয়াবাসীরা যতই ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত হোক না হোক, আত্মরক্ষার জন্যই আমেরিকাকে ‘ইমিগ্রেশান’ আইন করিতে হইয়াছে। ইহার মধ্যে অর্থনৈতিক কারণই বেশী, বর্ণবিদ্বেষ ততটা নাই।
বাংলার ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষেত্র হইতে বাঙালীরা ক্রমেই বিতাড়িত হইতেছে, ইহা বড়ই আক্ষেপের কথা। অবশ্য দোষ তাহাদের নিজেরই। ১৯৩১ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী তারিখের ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় জনৈক পত্রলেখক বলিয়াছেন:—
“১৮৯০ সালের কোঠায় আমি যখন বোম্বাই হইতে প্রথম কলিকাতায় আসি, তখন অধিকাংশ ব্যবসা বাণিজ্যই বাঙালীদের হাতে ছিল। কিন্তু উদ্যোগ, অধ্যবসায় এবং সাধুতার অভাবে তাহারা ব্যবসা ক্ষেত্র হইতে ক্রমে ক্রমে ইয়োরোপীয়, মাড়োয়ারী, খোজা, ভাটিয়া, মাদ্রাজী এবং পার্শীদের দ্বারা বহিষ্কৃত হইয়াছে।... বাঙালী ব্যবসায়ীরা, প্রায় সমস্ত বড় বড় ব্যবসায়ে যথা চাউল, পাট, চিনি, লবণ প্রভৃতিতে—প্রধান ছিল। কিন্তু ১৮৯০ সালের পর র্যালি ব্রাদার্স পূর্বেকার বাঙালী ফার্মের স্থলে মাড়োয়ারী ফার্মকে তাহাদের দালাল নিযুক্ত করিল। ঐ মাড়োয়ারী ফার্ম স্যার হরিরাম গোয়েঙ্কার সুদক্ষ পরিচালনায় এখনও কাপড়ের ব্যবসায়ে র্যালি ব্রাদার্সের দালালের কাজ করিতেছে। মাড়োয়ারী ফার্ম একটি বড় ব্যবসায়ী ফার্মের দালালী হস্তগত করায়, মাড়োয়ারী দোকানদার প্রভৃতি স্বভাবতই উহাদের নিকট হইতে নানারূপ সুবিধা পাইতে লাগিল এবং মাড়োয়ারীরা ক্রমে ক্রমে প্রায় সমস্ত ব্যবসা হইতে বাঙালীদিগকে বিতাড়িত করিতে লাগিল। সকলেই জানে যে, বর্তমান পাটের ব্যবসায় শতকরা ৮০ ভাগ মাড়োয়ারীদের হাতে।
“বাঙালীরা নিজেদের দোষে কিরূপে ব্যবসা বাণিজ্য হইতে স্থানচ্যুত হইতেছে, তাহার আর একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। রাধাবাজার স্ট্রীটে পূর্বে সমস্ত পশম ব্যবসায়ী বাঙালী ছিল। কিন্তু তাহারা দ্বিপ্রহরের পূর্বে তাহাদের দোকান খুলিত না। উহার ফলে কচ্ছী মুসলমান বোরারা—বাঙালী পশম ব্যবসায়ীদিগকে রাধাবাজার হইতে বিতাড়িত করিয়াছে।
করিতেছে এবং তাহার ফলে বেকার সমস্যা বাড়িতেছে। কম্যাণ্ডার কেনওয়ার্দি বলেন, আমেরিকায় প্রায় ২০ হাজার উকীল আছে, তাহাদের অধিকাংশেরই কোন কাজ নাই। একজন বিখ্যাত ইংরাজ গ্রন্থকার ও পর্যটক, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বহু স্থান ভ্রমণ করিয়াছেন। তিনি আমাকে বলিয়াছেন যে, আমেরিকায়—আইনের ব্যবসার সর্বাপেক্ষা শোচনীয় অবস্থা। নিউ ইয়র্কের অর্দ্ধেক উকীলেরই পাঁচ সেণ্ট দিয়া একখানি খবরের কাগজ কিনিবার সামর্থ নাই। তথাপি অতীতের মত বর্তমানেও নূতন নূতন লোক আইনের ব্যবসায়ে যোগদান করিতেছে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি হইতে প্রতি বৎসর প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার গ্রাজুয়েট বাহির হয়। ইহাদের এক চতুর্থাংশও কোন কাজ পায় না। শিক্ষা বিভাগের রিপোর্টে দেখা যায় যে, ১৯২৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশানে ৫,৬৩,২৪৪ জন পুরুষ এবং ৩,৫৬,১০০ জন স্ত্রীলোক ডিগ্রী লইয়াছে। এই যে কায়িক শ্রমের প্রতি অনিচ্ছা, ইহাই আমেরিকার প্রবল বেকার সমস্যা সৃষ্টির অন্যতম কারণ।”