পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩১৩

এমন ভাবে জড়িত যে, ইহা আমাদের জীবন ও চরিত্রের অংশ বিশেষ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহা যেন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে।[] কেরাণীগিরি বাঙালী চরিত্রের সঙ্গে এমনভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে, ধনী অভিজাত বংশের ছেলেরাও এ কাজ করিতে সঙ্কোচ বোধ করে না। গত অর্দ্ধ শতাব্দী ধরিয়া বাঙালীদের মধ্যে, বিশেষতঃ সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা আশ্চর্য ব্যাপার দেখা যাইতেছে। তাহারা ইয়োরোপীয় সদাগর আফিসে বা ব্যাঙ্কে লক্ষ টাকা মূল্যের কোম্পানীর কাগজ জমা দিয়া ক্যাশিয়ার বা সহকারী ক্যাশিয়ারের চাকরী গ্রহণ করে, কিন্তু তবু ব্যবসায়ে নামিবে না, কেননা তাহাতে ঝুঁকি আছে। যে কোন ঝুঁকি বা দায়িত্ব নেয় না, সে কোন লাভও করিতে পারে না, ইহা একটা সুপরিচিত কথা। কিন্তু আমাদের দেশের লোকেরা একথা স্মরণ রাখে না। এই ফর্মা প্রেসে দিবার সময় নিম্নলিখিত পত্রখানির প্রতি আমার দৃষ্টি পড়িল:—

সদাগরের কেরাণী

“সম্পাদক মহাশয়,

 লর্ড ইঞ্চকেপ প্রভৃতির মত বড় বড় ব্যবসায়ী এবং দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা বলেন যে, ভারত তাঁহাদের নিকট অশেষ প্রকারে ঋণী, বহু ভারতবাসীর জন্য তাঁহারা অন্নসংস্থান করিয়াছেন। ইয়োরোপীয় বণিকেরা গরীব ভারতীয় কেরাণীদিগকে এই ভিক্ষুক বৃত্তি দিবার জন্য গর্ব অনুভব করেন বটে, কিন্তু তৎপরিবর্তে ইহাদের নিকট তাঁহারা যে কাজ আদায় করিয়া লন, তাহা যৎকিঞ্চিৎ বেতনের তুলনায় ঢের বেশী। ৩০ টাকা মাহিনার একজন কেরাণী তাহার প্রভুর চিঠিপত্র লেখে, তাঁহার ব্যাকরণের ভুল সংশোধন করে, উহা ‘ফাইল’ করে, প্রয়োজনীয় পুঁথিপত্র গুছাইয়া রাখে; তাহার স্মরণ শক্তি প্রখর, কারবারে ১০।২০ বৎসর পূর্বে যাহা ঘটিয়াছে, তাহাও মনে রাখিতে হয়, ক্লিকেট ক্লাব, বোটিং ক্লাব, সুইমিং ক্লাব, বয়-স্কাউট সংক্রান্ত কার্যের সেক্রেটারী হিসাবে প্রভুর ব্যক্তিগত কাজও সে করে। প্রভু কহিলে সে দৌড়ায়, চেঁচাইতে বলিলে চেঁচায়, ‘মহিলা সভার’ চিঠিপত্র লেখা প্রভৃতি মেম সাহেবের ঘরের কাজও সে করে—এবং এ সমস্তই মাসিক ত্রিশ টাকা মাহিনার পরিবর্তে!—ইহাকে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ব্যভিচার ভিন্ন আর কি বলিব?

* * * *

 “যে সব বিদেশী ফার্ম ভারতে ব্যবসায় করিয়া ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছে, তাহারা ভারতীয় কেরাণীদের বুদ্ধি, পরিশ্রম এবং কর্মশক্তি সহায়েই তাহা করিয়াছে। যাহারা ইয়োরোপ বা আমেরিকা হইতে এদেশে আসিয়া ধনী হইয়াছে, ভারতীয় কেরাণীদের অধ্যবসায় ও বিশ্বস্ততাই তাহাদের উন্নতির প্রধান কারণ।........

 “পাশ্চাত্যের বণিকেরা আসিয়া ভারতীয় কেরাণীদের বুদ্ধি ও কর্মশক্তি কাজে খাটাইয়া, নিজেরা ধনী হয় এবং এ দেশ ত্যাগ করিবার সময় ঐ হতভাগ্য কেরাণীদের অকর্মণ্য, রুগ্নদেহ, দরিদ্র অক্ষম করিয়া ফেলিয়া যায়।

(অমৃতবাজার পত্রিকা, ২১। ৫। ৩২)

  1. আমার প্রকাশ্য বক্তৃতায় আমি, মুন্সেফ, ডেপুটী ম্যাজিষ্ট্রেট, কমিশনারের পার্সন্যাল অ্যাসিষ্ট্যাণ্ট, ইনস্পেক্টর জেনারেল এমন কি একাউণ্টাণ্ট জেনারেলদেরও “সম্মানার্হ কেরাণী” আখ্যা দিতে কুণ্ঠিত হই নাই।