পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩১৫

 ‘সদাগরের কেরাণী’ ভুলিয়া যায় যে, খাঁটি ভারতীয় ফার্মেও (যথা বোম্বাইয়ে) কেরাণীদের বাজার দর অনুসারে অতি সামান্য বেতন দেওয়া হয় এবং ব্যবসায়ীরা তাহাদের কাজে খাটাইয়া নিজেরা ধনী হয়।

 দশ বৎসর পূর্বে (১৯২২, জানুয়ারী ২৫শে) ‘ইংলিশম্যান’ ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন যে, বাঙালী কেরাণী লোপ পাইবে।

কলিকাতার পরিবর্তনশীল জনসংখ্যা

 উপরোক্ত শিরোনামায় একটি প্রবন্ধে ‘ইংলিশম্যান’ লিখিয়াছিলেন বাঙালীরা কিরূপে তাহাদের কার্যস্থান হইতে ক্রমশই বে-দখল হইতেছে:—

 “লোকে যখন বলে যে, গত ২০ বৎসরে কলিকাতার লোকসংখ্যার প্রভূত পরিবর্তন হইয়াছে, তখন তাহারা সাধারণতঃ কলিকাতার যে সব উন্নতি হইয়াছে, জীবনযাত্রার স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি পাইয়াছে, রাস্তা ঘাট, দালান কোঠা, আলো ও স্বাস্থ্যের ব্যবস্থা উন্নততর হইয়াছে, সেই সব কথাই ভাবে। তাহারা সর্বপেক্ষা যে বড় পরিবর্তন তাহাই লক্ষ্য করে না। কলিকাতা ক্রমেই অ-বাঙালী সহর হইয়া দাঁড়াইতেছে, এবং প্রতি বৎসরই অজস্র বিদেশী কলিকাতায় আমদানী হইতেছে—উহাদের উদ্দেশ্য কলিকাতায় বসবাস করিয়া জীবিকার্জন করা। ইহারা যে কেবল ভারতের অন্যান্য প্রদেশ হইতে আসে, তাহা নয়, পৃথিবীর সমগ্র অঞ্চল হইতেই আসে। যুদ্ধের সময় ভারতের বাহির হইতে লোক আসা বন্ধ হইয়াছিল, কিন্তু যুদ্ধের পর হইতে উহাদের সংখ্যা দ্রুতবেগে বাড়িয়া যাইতেছে। একথা সত্য যে, জার্মানেরা ভারত হইতে একেবারে বিদায় হইয়াছে, কিন্তু তাহাদের পরিবর্তে আমেরিকাবাসীরা আসিতেছে। তাহারাও জার্মানদের মতই কর্মশক্তিসম্পন্ন এবং কলিকাতায় বাস করিবার জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প। আর এক স্তরে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী স্থান সমূহ হইতে আগত লোকদের ধরিতে হইবে, উহারা বাঙালী দোকানদারদের সঙ্গে রীতিমত প্রতিযোগিতা করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তৃতীয় শ্রেণীর লোক মধ্য এসিয়া ও আর্মেনিয়া হইতে আগত, উহারাও কলিকাতায় বাঙালীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়া অন্ন সংস্থান করিয়া লইতেছে। চীনা পাড়াতেও লোক বাড়িতেছে এবং জুতা তৈরী ও ছুতারের কাজ বাঙালী মিস্ত্রীদের নিকট হইতে তাহারা প্রায় সম্পূর্ণরূপে বে-দখল করিয়াছে।

 “কিন্তু ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকের সঙ্গে প্রতিযোগিতাতেই বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান বেশী মার খাইতেছে। ২০ বৎসর পূর্বেও কলিকাতা সহরের ঘন বসতিপূর্ণ জায়গা গুলি বাঙালীদের দ্বারা পূর্ণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে কলিকাতার কোন অঞ্চল সম্বন্ধেই এমন কথা আর বলা যায় না। যুদ্ধের পূর্ব হইতেই অবশ্য মাড়োয়ারীদের আমদানী হইয়া আসিতেছে, কিন্তু এখনও উহা পঞ্চাশ বৎসরের বেশী হয় নাই। তৎপূর্বে মুচ্ছুদ্দী, দালাল, মধ্যস্থ ব্যবসায়ী, দোকানদার যাহারা কলিকাতার ঐশ্বর্য গড়িয়া তুলিতেছিল, তাহারা সকলেই ছিল বাঙালী। বড়বাজার বাঙালী কেন্দ্র ছিল এবং সেখান হইতেই সহরের ব্যবসা বাণিজ্য চারি দিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িত। বর্তমানে বড়বাজারের কথা বলিলেই মাড়োয়ারীদের কথা বুঝায়। মাড়োয়ারীরা কলিকাতার বড় বড় অর্থনীতিক সমস্যার মীমাংসা করে, এবং শেয়ার বাজারে, পাইকারী বাজারে সর্বত্রই তাহাদের প্রভাব। খুচরা দোকানদারীতেও পাঞ্জাবী বেনিয়া এবং হিন্দুস্থানী মুদীদের আমদানী হইয়াছে। উহারা অলি গলির মধ্যে নিজেদের ভাষায় লিখিত সাইনবোর্ড টাঙাইয়া পরম উৎসাহে ব্যবসা করিতেছে। কলিকাতার বিদেশী বস্ত্র বর্জনের সুযোগ লইরা বোম্বাইয়ে বোরা এবং পাঠান