পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

আত্মচরিত

প্রথম পরিচ্ছেদ

জন্ম—পৈতৃক ভদ্রাসন—বংশ পরিচয়—বাল্যজীবন

 ১৮৬১ সালের ২রা আগষ্ট আমি জন্মগ্রহণ করি। এই বৎসরটি রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাসে স্মরণীয়, কেননা ঐ বৎসরেই ব্রুক্‌স ‘থ্যালিয়ম’ আবিষ্কার করেন। আমার জন্মস্থান যশোর জেলার রাড়ুলি গ্রাম (বর্তমান খুলনা জেলায়)। এই গ্রামটি কপোতাক্ষী নদীতীরে অবস্থিত। কপোতাক্ষী ৪০ মাইল আঁকাবাঁকা ভাবে ঘুরিয়া কবিবর মধুসূদন দত্তের জন্মস্থান সাগরদাঁড়ীতে পৌঁছিয়াছে। এই নদীরই আরও উজানে বিখ্যাত সাংবাদিক শিশিরকুমার ঘোষের জন্মস্থান পলুয়া মাগুরা গ্রাম—পরে যাহা ‘অমৃতবাজার’ নামে পরিচিত হইয়াছে। রাড়ুলির উত্তরদিকে সংলগ্ন কাটিপাড়া গ্রাম, এই গ্রামেরই অধিবাসী ও জমিদার ঘোষ বংশের কন্যা কবি মধুসূদন দত্তের মাতা।[১] এই দুই গ্রাম অনেক সময়ে একসঙ্গে রাড়ুলি-কাটিপাড়া নামে অভিহিত হয়।

 আমার পিতা এক শতাব্দীরও পূর্বে ১৮২৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন মৌলবীর নিকট পারসী ভাষা শিখিয়াছিলেন। তখনকার দিনে ‘পারসী’ই আদালতের ভাষা ছিল। পিতা পারসী ভাষা বেশ ভাল জানিতেন, সঙ্গে সঙ্গে একটু আরবীও শিখিয়াছিলেন। তিনি অনেক সময় বলিতেন যে, যদিও তিনি সনাতন হিন্দুবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তবু কবি হাফিজের ‘দেওয়ানা’ তাঁহার মনের গতিকে সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে। তিনি গোপনে মৌলবী-দত্ত সুস্বাদু মরগীর মাংস পর্যন্ত খাইতেন। বলা বাহুল্য, যদি পরিবারের কেহ এই ব্যাপার জানিতে পারিতেন, তবে তাঁহারা পিতৃদেবের আচরণে স্তম্ভিত ও মর্মাহত হইতেন সন্দেহ নাই। বাড়ীতে লেখাপড়া শেষ করিয়া আমার পিতা ১৮৪৬ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণনগর কলেজে ইংরাজী বিদ্যা শিক্ষা করিতে যান। ঐ কলেজে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষার জন্য পড়িবার সময়, প্রসিদ্ধ শিক্ষক দেবচরিত্র রামতনু লাহিড়ী মহাশয়ের ছাত্র হইবার সৌভাগ্য তাঁহার হইয়াছিল। ঐ সময় কাপ্টেন ডি, এল, রিচার্ডসন কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। আমার পিতা সাক্ষাৎভাবে তাঁহার ছাত্র না হইলেও, তাঁহার ভাব ও চরিত্রের প্রভাবে কিয়ৎ পরিমাণে অনুপ্রাণিত হইয়াছিলেন। বাংলায় শিক্ষা প্রচারের অগ্রদূত এই ক্যাপ্টেন রিচার্ডসন কৃত “বৃটিশ কবিগণের জীবনী” (Lives of British Poets) শীর্ষক গ্রন্থখানি এখনও আমার নিকট আছে। এই গ্রন্থ বহুবার আমি পড়িয়াছি এবং এখানিকে আমি অমূল্য পৈতৃক সম্পদরূপে গণ্য করি।

 আমার পিতা যদি পরিবারিক কারণে হঠাৎ বাড়ী চলিয়া আসিতে বাধ্য না হইতেন, তাহা হইলে তিনি যথাসময়ে কলেজের শিক্ষা শেষ করিয়া সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষা দিতে পারিতেন।[২] আমার পিতা শিক্ষা অসম্পূর্ণ রাখিয়া কলেজ ছাড়িতে বাধ্য


  1. মধুসূদনের মাতা জাহ্নবী দাসী কাটিপাড়ার জমিদার গৌরীচরণ ঘোষের কন্যা।
  2. তখন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয় নাই।