এই অংশ ছাপাখানায় পাঠাইবার সময় আমি “লিবার্টি” পত্রে (১১-৮-৩২) N. C.R স্বাক্ষরিত একটি প্রবন্ধ পড়িলাম। ‘ম্যানচেষ্টার গার্ডিয়ানের’ পত্রপ্রেরকের অধিকাংশ কথার তিনি পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন:—
“বর্তমান শতাব্দীর আরম্ভ হইতে বাঙালীরা কেবল অনুচরের দল সৃষ্টি করিয়াছে, নেতার জন্ম দিতে পারে নাই, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সাগরেতী মাত্র করিয়াছে,—একথা বলিলে ভুল বলা হইবে। ইহা স্বীকার করিতে হইবে যে, বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত বাংলা দেশ ভারতের নেতৃত্ব করিয়াছে। বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশী আন্দোলনের সময় ভারতের রাজনীতি ক্ষেত্রে ও সার্বজনীন আন্দোলনে বাঙালীরই প্রাধান্য ছিল। উহার পর এই প্রাধান্য হইতে নামিয়া বাংলা অন্যান্য প্রদেশের সম পর্যায়ে দাঁড়ায়। ঐ সমস্ত প্রদেশের লোক তখন নিজেদের রাজনৈতিক জীবনকে সঙ্ঘবদ্ধ ও উন্নততর করিয়াছে এবং যে সমস্ত রাজনীতিক নেতা তাহাদের মধ্যে দেখা দিয়াছিলেন, তাঁহারা বাঙালী নেতাদের সঙ্গে বাদ প্রতিবাদে সমান ভাবে প্রতিযোগিতা করিতে পারিতেন। ইয়োরোপীয় যুদ্ধের সময় পর্যন্ত এই অবস্থা বর্তমান ছিল।...... কিন্তু বর্তমান শতাব্দীর প্রথম ভাগে বাঙালীরা ভারতের নেতৃত্ব করিয়াছেন, একথা অস্বীকার করাও যেমন ভুল,—‘ভিকটোরিয়ান যুগে’ বাঙালীদের যে প্রাধান্য ছিল, তাহা হইতে তাহারা চ্যুত হইয়াছে, ইহা অস্বীকার করাও তেমনি ভুল।”
(৮) বাঙালীদের ব্যর্থতার জন্য বাংলাদেশ হইতে বার্ষিক অর্থশোষণ
এ বিষয়ে অধিক আলোচনার প্রয়োজন নাই। বিগত আদমসুমারীর বিবরণে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২২ লক্ষ অ-বাঙালী (অর্থাৎ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোক) আছে। তাহারা মন্দার সময়ে কিম্বা ২।৩ বৎসর অন্তর স্ব-প্রদেশের বাড়ীতে যায়। বাংলায় কাজ চালাইবার জন্য নিজেদেরই কোন লোক রাখিয়া যায়। ই. আই. রেলওয়ের যাত্রীসংখ্যা পরীক্ষা করিলে দেখা যাইবে, অন্য প্রদেশ হইতে বাংলাদেশে ক্রমাগত লোক আমদানী হইতেছে। তাহাদের মধ্যে অল্প লোকেই স্ত্রীপুত্রাদি সঙ্গে আনে। মাড়োয়ারী, ভাটিয়া প্রভৃতিদের মধ্যে যাহারা এদেশে সপরিবারে স্থায়ী ভাবে বসতি করিয়াছে তাহাদের সংখ্যা বেশী নহে এবং তাহারা সাধারণতঃ কলিকাতাতেই থাকে। ২২ লক্ষের মধ্যে ২ লক্ষ স্ত্রীলোক ও শিশুদের সংখ্যা ধরা যাইতে পারে, ইহারা উপার্জন করে না। একজন কুলী, ধোবা বা নাপিত পর্যন্ত মাসে ২৫।৩০ টাকা উপার্জন করে। একশ্চেঞ্জ গেজেট বা ক্যাপিট্যালের পাতা উল্টাইয়া যদি দৈনিক ব্যবসায়ের হিসাব এবং “ক্লিয়ারিং হাউসের” কার্যাবলী পরীক্ষা করা যায়, তাহা হইলে স্পষ্ট দেখা যাইবে বাংলার চলতি কারবারের টাকা এবং স্থায়ী সম্পদের কত অংশ ব্যবসা-বাণিজ্য সংসৃষ্ট মাড়োয়ারী, ভাটিয়া প্রভৃতিদের হাতে আছে। তাহাদের মধ্যে অনেকে লক্ষপতি।[১] বাঙালীদের সেখানে স্থান নাই।
- ↑ ১৯২১ সালের আদমসুমারীর বিবরণে দেখা যায়, রাজপুতানা এজেন্সীর ৪৭,৮৬৫ জন এবং বোম্বাই প্রদেশের ১১,২৩৫ জন লোক বাংলাদেশের অধিবাসী হইয়াছে। প্রথমোক্তদের মধ্যে ১২,৫০৭ জন বিকানীরের লোক এবং ১০,৩১৬ জন জয়পুরের লোক কলিকাতাতেই আছে। আদমসুমারীর বিবরণ লেখক বলিয়াছেন,—“উত্তর ভারতের ব্যবসায়ীরা কলিকাতা সহরের ব্যবসা বাণিজ্যে ক্রমেই অধিক পরিমাণ অংশ গ্রহণ করিতেছে। কলিকাতার বাহিরেও তাহারা নিশ্চয়ই ঐরূপ করিয়া থাকে।” বোম্বাই হইতে এত লোক যে কলিকাতার আমদানী হইতেছে, তাহার কারণ দেখাইতে গিয়া তিনি বলিয়াছেন, “ঐ প্রদেশের ব্যবসায়ীরা অধিক সংখ্যায় কলিকাতায় আসাতেই এরূপ ঘটিতেছে।”