পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩১৯

 যদি এই সমস্ত লোকের মাসিক আয় গড়ে ৫০ টাকা ধরা যায়, তাহা হইলে উহারা বিশ লক্ষ লোকে মাসে অন্ততঃপক্ষে ১০ কোটী টাকা উপার্জন করিতেছে। অর্থাৎ বৎসরে প্রায় ১২০ কোটী টাকা বাংলাদেশ হইতে শোষিত হইতেছে[]। আমি যতদূর সম্ভব তথ্য দ্বারা আমার কথা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। অবশ্য, সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না এবং আমার হিসাব কতকটা অনুমান মাত্র, যদিও তাহার ভিত্তি সুদৃঢ়। বিশেষজ্ঞেরা যে সব হিসাব দিয়াছেন, তাহার দ্বারা আমার অনুমান অনেক সময়ই সমর্থিত হয়। বাংলা হইতে কত টাকা বোম্বাই, রাজপুতানা, বিহার এবং যুক্তপ্রদেশে বাহির হইয়া যাইতেছে, তৎসম্বন্ধে সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য নির্ণয় করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু যে হিসাব এখানে দেওয়া যাইতেছে, তাহা ধীর ভাবে বিবেচনা করিবার যোগ্য।

 সকলেই জানেন যে, মাড়োয়ারী এবং অন্যান্য স্বচ্ছল অবস্থার হিন্দুস্থানীরা আটা, ডাল, ঘি খাইয়া থাকে, ঐ সব জিনিষ তাহারা বাংলার বাহির হইতে নিজেরাই আমদানী করে। কেবল উড়িয়ারা ভাত খায়। সুতরাং আমরা বলিতে পারি যে—অবাঙালীরা যাহা উপার্জন করে, তাহা তাহাদের নিজেদের পকেটেই যায়। সুতরাং মাড়োয়ারী, ভাটিয়া বা পাঞ্জাবী যদিও কলিকাতায় থাকিয়াই অর্থ উপার্জন করে, তবু তাহাদের অর্থে বাংলার সম্পদ বৃদ্ধি হয় না, কিম্বা তাহারা বাংলার অধিবাসী হওয়াতে বাংলার কোন আর্থিক উন্নতি হয় না।[] তাহারা কামস্কাটকা বা টিম্বাক্‌টোর অধিবাসী হইলেও বাংলার বিশেষ কোন ক্ষতি হইত না।


  1. এই সংখ্যা অনেকের নিকট অসম্ভব ও অবিশ্বাস্য মনে হইতে পারে। ইহার প্রমাণ স্বরূপ বহু তথ্য আমার হাতে আছে। কলিকাতার নিকটবর্তী পাট কল সমূহের এলাকার যে সব ডাকঘর আছে, উহা হইতে ১৯২৯ সালে ১ কোটী ৭৬ লক্ষ টাকার মনি অর্ডার হইয়াছে।—Indian Jute Mills Association, Report, 1930.
     একজন বিহার প্রবাসী পদস্থ বাঙালী আমাকে লিখিয়াছেন:—“বিহার ও অন্যান্য প্রদেশের বাঙালীদের সম্বন্ধে আপনি যে যত্ন লইতেছেন, সেজন্য আপনাকে ধন্যবাদ। গত মাসে ছাপরা ডাকঘরেই বাংলা হইতে ১০ লক্ষ টাকা মনি অর্ডার আসিয়াছে। ইহা এক সারণ জেলাতেই বাংলা হইতে আগত টাকার হিসাব।
     “বাংলা হইতে এখানে যে সব মনি অর্ডার আসিয়াছে, তাহার তিন মাসের হিসাব দিতেছি—
    জানুয়ারী (১৯২৭) ... ... টাকা ১১,৫৮,০০০
    ফেব্রুয়ারী (১৯২৭) ... ... টাকা ১১,০২,৮০০
    মার্চ্চ (১৯২৭) ... ... টাকা ৯,৩৭,৯০১

     তিন মাসের গড় ধরিলে মাসে প্রায় ১০ লক্ষ টাকা হয়। পক্ষান্তরে ছাপরা হইতে বাংলায় মাসেমাসে গড়ে এক হাজার টাকার বেশী বাংলাদেশে মনি অর্ডার হয় না। এখানে যে কয়েক জন বাঙালী থাকে, তাহারা কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করে,—বিশেষতঃ, আমরা এই প্রদেশের অধিবাসী হইয়াছি বলিয়া এখানেই উপার্জিত অর্থ ব্যয় করি। কিন্তু একটি স্কুলের মাষ্টারীও যদি বাঙালীকে দেওয়া হয় অমনি চারিদিক হইতে চীৎকার উঠে—বিহার বিহারীদের জন্য!”
     “বাংলার সম্পদ শোষণ” এই শীর্ষক প্রবন্ধে ১৯২৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকা লিখিয়াছেন,—“১৯২৬ সালে এক মাত্র কটক জেলাতেই বাংলা হইতে ৪ লক্ষ টাকার মনি অর্ডার হইয়াছিল। এখানে বলা প্রয়োজন যে, উড়িয়ারা বাংলাদেশে রাঁধুনি, চাকর, প্লাম্বার এবং কুলী হিসাবে অর্থ উপার্জন করে। সুতরাং অন্যান্য অ-বাঙালী অপেক্ষা উড়িয়ারা কম টাকা দেশে পাঠাইতে পারে। কিন্তু মনি অর্ডার যোগে তাহারা তাহাদের সঞ্চিত অর্থের অতি সামান্য অংশই পাঠায়। বেশীর ভাগ অর্থ তাহারা বাড়ী যাইবার সময় সঙ্গে লইয়া যায়।”

  2. স্থানীয় কোন সংবাদপত্রে জনৈক পত্রপ্রেরক লিখিয়াছেন—(৬ই জানুয়ারী, ১৯৩২):
     “অ-বাঙালীদের সাধারণ প্রথা এই যে, তাহারা নিজেদের জাতীয় মুচী, নাপিত, ধোবা, ভৃত্য প্রভৃতি রাখে। তাহার অর্থ এই যে, বাঙালীরা অ-বাঙালীদের নিকট হইতে এক পয়সা লাভ করিতে