পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩২০
আত্মচরিত

 মাড়োয়ারীরা বাংলার চারি দিকে তাহাদের জাল বিস্তার করিয়াছে। তাহারা চতুর, বেশ জানে যে, বাঙালীদের চোখ একবার খুলিলে এবং ব্যবসার দিকে তাহাদের মতি গেলে, তাহাদের (মাড়োয়ারীদের) স্থানচ্যুত হইতে হইবে এবং বাংলাদেশে এ সকল সুবিধা আর তাহারা ভোগ করিতে পারিবে না। এই আত্মরক্ষার প্রেরণাতেই তাহারা কোন বাঙালী যুবককে তাহাদের ফার্মে শিক্ষানবিশরূপে লইতে চায় না। বাঙালী যুবকেরা কখন কখন ইয়োরোপীয় ফার্মে শিক্ষানবিশ হইতে পারে এবং ক্রমশঃ উচ্চতর পদ লাভ করিয়া অবশেষে অংশীদার পর্যন্ত হইতে পারে। কিন্তু একজন বাঙালীর পক্ষে মাড়োয়ারী বা ভাটিয়া ফার্মে শিক্ষানবিশ হওয়া অসম্ভব। কেবল ইহাই নহে। আমি এমন অনেক দৃষ্টান্ত জানি যে, বাঙালী যুবকেরা যে সব ছোটখাট ব্যবসা করিয়াছিল, তাহা একেবারে উঠিয়া গিয়াছে। মাড়োয়ারী প্রতিযোগীরা অত্যন্ত কম দরে মাল বিক্রয় করিয়া ঐ সব বাঙালী ব্যবসায়ীর আর্থিক ধ্বংস সাধন করিয়াছে! এই কারণে বলিতে হয় যে, মাড়োয়ারীরা নামে কলিকাতার অধিবাসী হইলেও তাহারা বাংলার স্বার্থের বিরোধী, এক কথায় এই সব অ-বাঙালী অধিবাসীদের ব্যবসার স্বার্থ ছাড়া বাংলার সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধ নাই, এবং তাহারা বাংলার অর্থে পুষ্ট হইয়া বাংলারই আর্থিক উন্নতির পক্ষে বাধা স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছে।

 আমি স্বীকার করি যে, পাট ও চা’এর ব্যবসায়ে পৃথিবীর বাজার তাহাদের আয়ত্ত। এই দুই ব্যবসায়ে যে লাভ হয়, তাহাতে বাংলার অর্থ শোষিত হয় না, কিন্তু তদ্ব্যতীত যে ১ কোটী ২০ লক্ষ টাকার কথা আমি উল্লেখ করিয়াছি, তাহা বাংলারই শোষিত অর্থ। বাংলা হইতে অ-বাঙালীদের উপার্জিত প্রত্যেকটি টাকা বাংলার হতভাগ্য সন্তানদের মুখ হইতে ছিনাইয়া লওয়া খাদ্যের সমান।

 যখনই কোন যুবককে উপদেশ দেওয়া হয় যে, কেরাণীগিরি বা স্কুল মাষ্টারী না করিয়া ব্যবসা বাণিজ্য কর,—তখনই সে মামুলী জবাব দেয়—“কোথায় মূলধন পাইব?” ১৯০৬ সালে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার সময় হইতে, দেশহিতকামী ব্যক্তিরা বহু যুবককে ব্যবসা করিবার জন্য মূলধন দিয়াছেন, একথা আমি জানি। কিন্তু প্রায় সর্বত্রই উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইয়াছে, ঐ সব যুবকেরা ব্যবসায়ে সফলকাম হইতে পারে নাই। বস্তুতঃ, ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করিতে হইলে প্রথমতঃ রীতিমত শিক্ষানবিশী করা প্রয়োজন। আগে ক্ষুদ্র আকারে ব্যবসা আরম্ভ করিয়া অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতে হইবে এবং যদি প্রথমাবস্থায় সাফল্য লাভ করা নাও যায়, তবু ব্যবসায় সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হইতে পারা যায়। ব্যর্থতাই সাফল্যের অগ্রদূত। আমাদের সাধারণ যুবকেরা ব্যবসার আরম্ভেই যদি ব্যর্থ হয়, তাহা হইলে তাহারা ভগ্নহৃদয় হইয়া পুনরায় সেই পুরাতন বাঁধা পথ (চাকরী) অবলম্বন করে।

 বাংলাদেশে একটা প্রবাদ আছে যে, মাড়োয়ারীরা প্রথমতঃ লোটা কম্বল ও ছাতু লইয়া ব্যবসা আরম্ভ করে। রেলওয়ে হইবার পূর্বে মারবারের মরুভূমি হইতে তাহারা পায়ে হাঁটিয়া বাংলাদেশে আসিত। এখনও তাহারা ঐরূপই করে, প্রভেদের মধ্যে পায়ে হাঁটার পরিবর্তে রেলগাড়ীতে চড়ে। আর আমাদের যুবকেরা বিলাসী ও অলস; তাহারা চায় কোন কষ্ট না করিয়া ফাঁকি দিয়া কার্যসিদ্ধি করিতে। কোটীপতি ব্যবসায়ী কার্নেগী যুবকদিগকে যে উপদেশ দিয়াছেন, এই প্রসঙ্গে তাহা উল্লেখযোগ্য:—

 “আজকাল দারিদ্র্যকে অনিষ্টকর বলিয়া আক্ষেপ করা হয়। যে সমস্ত যুবক ধনীর


    পারে না। ইয়োরোপীয় ফার্মগুলি কিছু সাধারণতঃ বাঙালী কর্মচারীদের সাহায্যে তাহাদের আফিস ও কাজ কারবার চালাইয়া থাকে।