“আমি আপনার বিশ্বাসপ্রবণ ভাবের কথা জানি, সেই জন্যই আপনাকে আসিতে বলিয়াছিলাম। আমার উদ্দেশ্য আপনাকে সতর্ক করিয়া দেওয়া—যাহাতে সরলহৃদয় বাঙালীদের মত আপনিও বিভ্রান্ত না হন।” Gandhi: Autobiography, vol. II.
অন্য প্রদেশের লাভের জন্য বাংলাদেশ ও তাহার দরিদ্র কৃষকদের কি ভাবে শোষণ করা হইতেছে, তাহার আর একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। বিদেশ হইতে আমদানী করোগেট টিনের (ইস্পাতের) উপর অতিরিক্ত শুল্ক বসাইয়া টাটার লৌহশিল্পজাতকে যে ভাবে সংরক্ষিত করা হইয়াছে, তাহাতে বাংলার স্বার্থকেই বলি দেওয়া হইয়াছে, ইহা আমি নানা তথ্য সহকারে প্রমাণ করিতে পারি। ইম্পিরিয়াল প্রেফারেন্স বা সাম্রাজ্যবাণিজ্য নীতির জন্য কেবল মাত্র ব্রিটিশ লৌহজাত এই অতিরিক্ত শুল্ক হইতে নিষ্কৃত পাইয়াছে। বর্তমান আমদানী শুল্কের ফলে বাংলাদেশকে দ্বিগুণ ক্ষতি সহ্য করিতে হইয়াছে। বাংলা করোগেট টিনের প্রধান খরিদ্দার,—বাংলার দরিদ্র লোকেরা বিশেষ পূর্ব বঙ্গের কৃষকেরা এই আমদানী শুল্ক বৃদ্ধির জন্য করোগেট টিনের জন্য বেশী মূল্য দিতে বাধ্য হয়। যখন প্রতি টনে দশ টাকা শুল্ক ছিল, তখন করোগেট টিনের দাম ছিল—প্রতি টন ১৩৭৲ টাকা। ১৯২৫—২৬ সালে টাটা কোম্পানীর চীৎকারের ফলে ঐ শল্ক বৃদ্ধি পাইয়া টন প্রতি ৪৫, টাকা হইল। ১৯২৬ হইতে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত ঐ শুল্ক কিছু কমিয়া টন প্রতি ৩০৲ টাকা থাকে। ১৯৩১ সালে ঐ শুল্ক হঠাৎ বাড়িয়া টন প্রতি ৬৭৲ টাকা হইয়া দাঁড়ায়, ১৯৩১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শতকরা ২৫৲ টাকা ‘সার চার্জের’ দরুণ উহা বৃদ্ধি পাইয়া টন প্রতি ৮৩৸৹ আনায় উঠে। এই শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বাংলার দরিদ্র কৃষকদের বিষম ক্ষতি হইল। এদিকে টাটা কোম্পানী শুল্ক বৃদ্ধির সুযোগ লইয়া করোগেট টিনের দাম টন প্রতি ২১৮৲ টাকা চড়াইয়া দিয়াছে। সরকারী সাহায্য প্রাপ্ত এই দেশীয় শিল্পের সঙ্গে বিদেশী শিল্পের মূল্যের এত বেশী তফাত যে, দেশবাসী দাবী করিতে পারে কেন এই দেশীয় শিল্পের উন্নতি সাধন করিয়া মূল্য সুলভ করিবার ব্যবস্থা হইবে না? করোগেট টিনের ব্যবসা পূর্বে বাঙালী ব্যবসায়ীদের হাতে ছিল, কিন্তু অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধির ফলে ঐ সমস্ত বাঙালী ব্যবসায়ীরা ধ্বংস পাইতে বসিয়াছে। এখন অ-বাঙালী ব্যবসায়ীরা বাঙালীদের স্থানচ্যুত করিয়া ক্রমে ক্রমে এই ব্যবসা হস্তগত করিতেছে। কেননা টাটারা এখন আর বাঙালী ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কারবার করিতে প্রস্তুত নহে। সুতরাং আমি যে বলিয়াছি, বোম্বাইওয়ালাদের লাভের জন্য বাঙালীদের শোষণ করা হইতেছে, তাহাদের স্বার্থ বলি দেওয়া হইতেছে, তাহা এক বর্ণও মিথ্যা নয়। অদৃষ্টের পরিহাসে বাংলা বোম্বাইয়ের শোষণক্ষেত্র হইয়া উঠিয়াছে, ঐ প্রদেশের ব্যবসায়ীরা বাংলায় আসিয়া বাঙালীদের স্কন্ধে চড়িয়া ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিতেছে।
টাটা কোম্পানী এত কাল ধরিয়া সংরক্ষণ নীতি ও সরকারী সাহায্যের সুবিধা ভোগ করিবার ফলে যদি নিজেদের পায়ে দাঁড়াইতে এবং বিদেশী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইত, তবে বাংলার লোকেরা যে স্বার্থ ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছে, তাহার একটা সার্থকতা থাকিত। অর্থনীতি শাস্ত্রের ইহা একটা সুপরিচিত সত্য যে, কোন শিশু শিল্পকে রক্ষা করিবার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংরক্ষণ নীতি অবলম্বন করা যাইতে পারে। কিন্তু চিরকাল ধরিয়া এরূপ সংরক্ষণ করা যাইতে পারে না, কেননা তাহাতে অযোগ্যতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় এবং পরিণামে তাহার দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক দুর্গতি ঘটে। টাটা কোম্পানীর দৃষ্টান্তে ইহা প্রমাণিত হইয়াছে। এই দরিদ্র দেশের অধিবাসীদের অবস্থার তুলনায় ব্রিটিশ শাসন ব্যয়সাধ্য বলিয়া গণ্য হয়। কিন্তু টাটারা তাহার উপর টেক্কা দিয়াছে। বহু বৎসর পূর্বে স্যার দোরাব টাটা গর্ব করিয়া বলিয়াছিলেন, তাঁহার