কারবারে বিদেশ হইতে আনীত বিশেষজ্ঞদিগকে কোন কোন ক্ষেত্রে বড় লাটের চেয়েও বেশী বেতন দেওয়া হয়; এবং এই জন্যই বুঝি বাংলাদেশকে এরূপ ভাবে শোষণ করা হইয়াছে!—আমদানী শুল্কের বৈধতা বা অবৈধতা লইয়া বিচার করা আমার উদ্দেশ্য নহে, আমি বলিতে চাই যে, বোম্বাইকে রক্ষা ও তাহার ঐশ্বর্য বৃদ্ধির অর্থ বাংলার দুর্গতি। এই শোষণ কার্যের বিরাম নাই এবং ইহা ক্রমেই বাংলার পক্ষে বেশী অনিষ্টকর হইয়া উঠিতেছে।
তারপর, চিনি শিল্পের কথা ধরা যাক। ট্যারিফ বোর্ডের সুপারিশে ভারতে আমদানী সাদা চিনির উপর মণ করা ছয় টাকা শুল্ক বসিয়াছে এবং এই ভাবে সংরক্ষিত হইয়া দেশীয় চিনি শিল্প দ্রুত উন্নতি লাভ করিতেছে। যে সব চিনির কল আছে, তাহারা বার্ষিক শতকরা ২৫৲ টাকা হইতে ৫০৲ টাকা পর্যন্ত লভ্যাংশ দিতেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও বিহারে প্রতি বৎসর গড়ে ২৫টি করিয়া চিনির কল স্থাপিত হইতেছে এবং আশা করা যাইতেছে যে কয়েক বৎসরের মধ্যে যে লভ্যাংশ পাওয়া যাইবে, তাহাতেই মূলধন উঠিয়া আসিবে। পূর্বেই দেখাইয়াছি, বাংলাদেশ ভারতে আমদানী সাদা চিনির বড় খরিদ্দার ছিল। সুতরাং যুক্ত প্রদেশ এবং বিহারের চিনি যে বাংলাদেশেই সর্বাপেক্ষা বেশী বিক্রয় হইবে, ইহা স্বাভাবিক। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, এই সব চিনির কলের কোনটাই বাঙালীর উদ্যোগে বা মূলধনে স্থাপিত হয় নাই। এখানেও আমাদের জাতির অক্ষমতা ও কর্মবিমুখতার পরিচয় পাওয়া যায়।
বোম্বাই মিল সমূহে ম্যানেজিং এজেণ্টদের অযোগ্যতা প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছে। তাহারাও তাহাদের ব্যবসার সুবন্দোবস্ত করিতে ইচ্ছুক নহে। আমরা দেখিতেছি ইণ্ডিয়ান টেক্সটাইল অ্যাসোসিয়েশান গবর্ণমেণ্টের নিকট প্রস্তাব করিয়াছেন যে, ভারতে আমদানী জাপানী বস্ত্রের উপর শতকরা এক শত ভাগ শুল্ক বসানো হোক। তাহাদের আবেদন তদন্তের জন্য ট্যারিফ বোর্ডের নিকট প্রেরিত হইয়াছে এবং খুব সম্ভব গবর্ণমেণ্ট আমদানী শুল্ক যথেষ্ট পরিমাণে বৃদ্ধি করিবেন।
একথা বলা বাহুল্য যে, টাটার লোহার কারখানা, বস্ত্র শিল্প, লবণ শিল্প এবং চিনি শিল্পের একটা বৃহৎ অংশ, বোম্বাইয়ের মূলধনীদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। বর্তমানে গবর্ণমেণ্টের আর্থিক অবস্থা যেরূপ, তাহাতে তাঁহারা ভারতের করদাতাদের অর্থে নিজেদের তহবিল ভর্তি করিবার সুযোগ পাইলে খুসী হন। সতরাং ‘সাম্রাজ্যের স্বার্থের’ যদি ক্ষতি না হয়, তবে গবর্ণমেণ্ট সংরক্ষণ নীতি সমর্থন করিতে সর্বদাই প্রস্তুত। বিশেষ ভাবে পরীক্ষা করিলে দেখা যাইবে যে, এই সংরক্ষণ শুল্কের বোঝা বেশীর ভাগ বাঙালী ক্রেতাদেরই বহন করিতে হয়। যে ‘ট্রাষ্ট প্রথা’ আমেরিকার সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যকে করতলগত করিয়াছে, স্পষ্টই বুঝা যায়, তাহা আমাদের দেশেও তাহার বিষাক্ত প্রভাব বিস্তার করিতেছে। অতিরিক্ত রক্ষণ শুল্কের দ্বারা বোম্বাইয়ের শিল্পের কোন উন্নতি হয় নাই, বরং উহার ফলে বাংলার দরিদ্র ক্রেতাগণ ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। এক কথায় আমাদের অক্ষমতার জন্য বাংলাদেশ শিল্প বাণিজ্যে বোম্বাইয়ের মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছে। এমন কি, কলিকাতা ব্যবসা বাণিজ্যে বোম্বাইয়ের ‘লেজুড়’ হইয়া দাঁড়াইতেছে, একথা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।
ইন্সিওরেন্স কোম্পানী কর্তৃক বাংলার অর্থ শোষণ
ভারতীয় এবং বিদেশী উভয় প্রকার ইনসিওরেন্স কোম্পানী গুলি মিলিয়া বাংলাদেশের অর্থ নিয়মিত ভাবে শোষণ করিতেছে। ‘ভারতীয়’ বলিলেই ‘বোম্বাই প্রদেশীর’ বুঝিতে হইবে,—ইনসিওরেন্স কোম্পানীর পক্ষে একথা বিশেষ ভাবেই খাটে।