পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩২৯

 “আমি বহু মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীকে প্রশ্ন করিয়াছি, জেরা করিয়াছি। আইনজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসাবে আমি তাহাদের ক্ষমতা ও যোগ্যতার পরিচয় ভালরূপেই জানি। আমার স্থির সিদ্ধান্ত এই যে, এই অবনতির অবস্থাতেও বাঙালীরা ঐ সব লোকেদের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিতে বহু গুণে শ্রেষ্ঠ। মাড়োয়ারীরা ব্যবসায়ে কেন সাফল্য লাভ করে এবং বাংলার বাজার এমন ভাবে কিরূপে তাহারা দখল করিয়াছে, আমি অনেক সময় তাহার কারণ বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। তাহাদের কোন শিক্ষা নাই, কোন বিশেষ জ্ঞান নাই এবং তাহাদের সামাজিক প্রথা ও আচার ব্যবহার অত্যন্ত অনুদার ও সঙ্কীর্ণ। তবে কেন তাহারা এমন সাফল্য লাভ করে? আমার বিশ্বাস যে, মাড়োয়ারীদের নিজেদের মধ্যে এমন বিশ্বাস ও সহযোগিতার ভাব বর্তমান যাহা বাহিরের লোকে ধারণা করিতে পারে না। বাঙালীদের মধ্যে আমি তাহা দেখিতে পাই না।

 “মাড়োয়ারীদের মধ্যে হাজার হাজার টাকার লেন দেন হইতেছে, তাহার কোন দলিল পত্র রাখা হয় না, এমন কি রসিদও নেওয়া হয় না। জহরতের প্যাকেট, হীরা মুক্তা প্রভৃতি দালালদের ও দর-দালালদের হাতে হাতে ঘুরে, তাহার কোন রসিদ থাকে না।

 “দ্বিতীয়তঃ, নূতন নূতন চাঞ্চল্য ও উত্তেজনার মোহে তাহারা শক্তি ক্ষয় করে না। আমি জানি না এ বিষয়ে কি করা যাইতে পারে। আমি ভদ্র যুবকদের ব্যবসায় শিখাইবার জন্য নিজে একটি ‘ডেয়ারী’ স্থাপন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলাম। কয়েকজন বন্ধু মিলিয়া এজন্য ৩৫ হাজার টাকা দিয়াছিলাম। দেখিলাম—বাঙালী যুবকদের অসাধুতা এবং কর্ম বিমুখতা ভয়াবহ। ৩৫ হাজার টাকাই নষ্ট হইল আরও পাঁচ হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়া আমাদিগকে ঋণ শোধ করিতে হইল।

 “আর একটি প্রচেষ্টায় আমার পাঁচ হাজার টাকা নষ্ট হইয়াছে—সেখানেও অবস্থা একই রকম। আমি লাভের জন্য এই সব প্রচেষ্টা করি নাই। বস্তুতঃ যদি চেষ্টা সফল হইত, আমার কোন লাভ হইত না। তাহাদের সঙ্গে আমার চুক্তি ছিল যে, পাঁচ বৎসর তাহারা আমার টাকা খাটাইবে, তাহার পর ক্রমশঃ বিনা সুদে ঐ টাকা পরিশোধ করিবে। আমি জানি, এই সব সমালোচনা করা সহজ—কিন্তু কি উপায় আছে, তাহাও আমি দেখিতে পাইতেছি না।

 “আপনি দেশের কাজে আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন, আর আমি বিলাসিতার মধ্যে বাস করিতেছি। আপনিই আমার চেয়ে এ বিষয়ে ভাল বিচার করিতে পারিবেন। আমরা যদি কৃষি ও শিল্প বাণিজ্যের উন্নতি করিতে পারি, রাজনৈতিক ক্ষমতা স্বভাবতই আমাদের হাতে আসিবে। কিন্তু আমাদের সমস্ত শক্তি শাসনসংস্কার, মন্ত্রীত্ব এবং ভোটের জন্য ব্যয় হইতেছে। এই সব অসার জিনিষ অসঙ্গত প্রাধান্য লাভ করিয়াছে।

 “সম্ভবতঃ যে সব বিষয় সকলেই জানে তৎসম্বন্ধে বাজে বকিয়া আমি নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতেছি। আমি এ বিষয়ে নূতন কিছু বলিতে পারি নাই। আশা করি, আপনি আমাকে এই সব অসংলগ্ন কথার জন্য ক্ষমা করিবেন।”

 মিঃ বি. এম. দাস ন্যাশনাল ট্যানারী এবং সরকারী ট্যানিং রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ট্যানারীর কাজে বিশেষজ্ঞ হিসাবে সমগ্র ভারতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি ব্যবসায়ে বাঙালীদের ব্যর্থতা সম্বন্ধে আমার নিকট নিম্নলিখিত অভিমত ব্যক্ত করিয়াছেন:—

 “আপনার পত্র পাইয়াছি। অবাঙালীদের তুলনায় বাঙালীদের ব্যবসায়ে যোগ্যতা কিরূপ তাহা আপনি জানিতে চাহিয়াছেন।

 “আপনার বোধ হয় স্মরণ আছে যে, কলেজ হইতে বাহির হইয়াই আমি এই কাজে যোগদান করি। ইহাতে প্রায় ১৫ বৎসর আছি। কলিকাতার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের সহিত কারবারের অভিজ্ঞতা আমার পূর্বে ছিল না। সুতরাং আমি খোলা মন লইয়াই কাজ