আরম্ভ করি, কোন সম্প্রদায় সম্বন্ধে আমার বিশেষ কোন ধারণা ছিল না। পক্ষান্তরে, নিজে বাঙালী বলিয়া, আমি স্বভাবতঃ বাঙালীদের সঙ্গেই কারবার করিতে ভালবাসিতাম এবং তাহাদিগকে কাজের বেশী সুযোগ দিতাম।
“কিন্তু শীঘ্রই আমি বুঝিতে পারিলাম, যে কারবার আমি করিতাম তাহাতে বাঙালী ব্যবসায়ী খুব কমই ছিল, অধিকাংশই অবাঙালী। আমি ইহাতে সন্তুষ্ট হইতাম না এবং ইচ্ছা করিতাম, এই কাজে বাঙালী ব্যবসায়ীরা বেশী আসে। সেই জন্য আমি বাঙালী ব্যবসায়ীদিগকে আমাদের সঙ্গে কারবার করিতে উৎসাহ দিতে লাগিলাম এবং তাহাদিগকে সর্বপ্রকার সুযোগ সুবিধা দিলাম। আমার মনের ভাব ছিল যে, অবাঙালী ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে বাঙালীদের সঙ্গে যদি আমি কারবার করিতে পারি, তবে আমি অধিকতর নিরাপদ হইতে পারিব। কিন্তু বাঙালীদের সঙ্গে কয়েকটি কারবার করিয়াই আমার এ মোহ দূর হইল।
“গত তের বৎসরের মধ্যে আমি পাঞ্জাবী মুসলমান, খোজা, হিন্দুস্থানী, বিহারী মুসলমান এবং বাঙালীদের সঙ্গে কারবার করিয়াছি এবং তাহাদের ব্যবসায়ে যোগ্যতা, ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে কিছু জ্ঞান হইয়াছে। এই জ্ঞানের উপর নির্ভর করিয়াই আমি এখন কারবার করি। আমি দৃষ্টান্ত স্বরূপ, কেবল একটি সম্প্রদায়ের কথা বলিব।
“পাঞ্জাবী মুসলমান—আমার অভিজ্ঞতায় তাহারা ব্যবসায়ে সাধু, বিশ্বাসী, ছলচাতুরীহীন। তাহারা বিশ্বাস করে এবং বিশ্বাস লাভ করিতে চায়। তাহারা অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং মিতব্যয়ী।
“গত ১৫ বৎসরে আমি পাঞ্জাবী ব্যবসায়ীদের নিকট বিশ্বাসের উপর প্রায় এক কোটী টাকার মাল বিক্রয় করিয়াছি। ব্যবস্থা এইরূপ যে, মাল সরবরাহ করিবার ৬০ দিন পরে মূল্য দিতে হইবে। তাহারা সাধারণতঃ ঠিক সময়ে মূল্য দেয়, ইহাই আমার অভিজ্ঞতা। যদি কোন বিশেষ কারণে তাহারা নির্দিষ্ট দিনে মূল্য না দিতে পারে, তবে তাহারা পূর্ব হইতে খবর দেয় এবং আরও সময় চায়। পাঞ্জাবী মুসলমান ব্যবসায়ীর নিকট হইতে বাকী টাকা আদায় করিবার জন্য আমাকে কখন আদালতে যাইতে হয় নাই।
“তাহারা কখন চুক্তি ভঙ্গ করে না, চুক্তির সর্ত মানিয়া যদি লোকসান হয়, তাহা হইলেও নয়। একবার যে মাল তাহাদের নিকট বিক্রয় করা হয়, উহা খারাপ বলিয়া তাহারা কখন মাল ফেরত দেয় না। তাহারা বরং তজ্জন্য ‘রিবেট’ চাহে এবং আমরাও সন্তুষ্টচিত্তে ‘রিবেট’ দিই।
“তাহারা ক্বচিৎ চাকরী লইয়া থাকে। যাহারা অত্যন্ত গরীব, তাহারাও চাকরী করা অপেক্ষা রাস্তায় ফিরি করিয়া মাল বিক্রয় করা শ্রেয়ঃ জ্ঞান করে। সাধারণতঃ তাহারা সকাল ৬টার সময় কাজ আরম্ভ করে এবং রাত্রি ১০টা পর্যন্ত কাজ করে। আহারের জন্য তাহারা মধ্যাহ্নে আধ ঘণ্টা এবং সন্ধ্যায় আধ ঘণ্টা ব্যয় করে। তাহারা মিতাহারী, কখনও বেশী খাইয়া পেট ভর্তি করে না।
“তাহারা স্বল্পব্যয়ে সাদাসিধা ভাবে জীবন যাপন করে। ২০।৩০ জন একত্রে কোন বাড়ী ভাড়া করে, সেখানে রাত্রিকালে তাহারা শয়ন করে। দৈনন্দিন কাজের জন্য যেখানে থাকে, দিনের আহার সেইখানেই সমাধা করে। আমাদের ন্যায় স্কুল কলেজে তাহারা পড়ে না। যখন কোন বাঙালী ভদ্রলোক ব্যবসা আরম্ভ করে, তখন সে কাজে তাহার কোন যোগ্যতা থাকে না। সে অলস অমিতব্যয়ীর ন্যায় কাজ করে এবং ফলে সমস্ত গুলাইয়া ফেলে, ব্যবসায়ে ব্যর্থ হয়। তাহার মধ্য যুগের জীবন যাপন প্রণালী, অলস প্রকৃতি, শ্রমসাধ্য কর্মে অনিচ্ছা, বাধা বিপত্তি ও কঠোরতা সহ্য করিতে অপ্রবৃত্তি, বাল্যবিবাহ এবং যৌথ পরিবার