প্রথা—এই সমস্ত জালে জড়িত হইয়া তাহার অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠে। যখনই কোন যুবক কোন ছোট খাট ব্যবসা আরম্ভ করে, তখনই তাহার পরিবারের লোকেরা তাহার নিকট সাহায্য দাবী করিয়া চীৎকার করিতে থাকে। ফলে যুবক ব্যবসায়ী তাহার সমস্ত টাকা, এমন কি মহাজনের টাকা পর্যন্ত খরচ করিয়া ফেলে এবং ব্যবসা বন্ধ করিতে বাধ্য হয়। এ কাহিনী করুণ, বেদনাদায়ক, কিন্তু সত্য।
“সাফল্য লাভ করিতে হইলে, ব্যবসাবুদ্ধির বিকাশ করিতে হইবে। যুবকদিগকে পরিশ্রমপটু, কঠোরকর্মী, বিশ্বস্ত হইতে হইবে। তাহাদের সাধাসিধা জীবন যাপন করিতে হইবে, পারিবারিক বাধা বিপত্তি হইতে মুক্ত হইতে হইবে। এই সমস্ত তাহার গলায় পাষাণভারের মত ঝুলিয়া থাকে।”
জনৈক অর্থনীতি শাস্ত্রের অধ্যাপক আমাকে জানাইয়াছেন,—“কয়েক বৎসর পূর্বে ঢাকার একজন প্রধান পাটের ব্যবসায়ীকে আমি জিজ্ঞাসা করি, বাঙালীরা কেন পাটের ব্যবসা হইতে বিতাড়িত হইতেছে। তিনি দুইটি কারণ প্রদর্শন করেন—(১) মাড়োয়ারীদের নিম্নতর জীবিকার আদর্শ; (২) নিজেদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে কারবারে মাড়োয়ারীগণ অন্যান্য বিদেশীদের তুলনায় সাধু।” সকল ব্যবসায় সম্পর্কেই এই কথাগুলি খাটে বলিয়া আমার বিশ্বাস।
শ্রীযুত যোগেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় পাঁচ টাকা মাহিনায় রাঁধুনীর কাজে জীবন আরম্ভ করেন। এখন তিনি কলিকাতা বিল্ডার্স ষ্টোরস লিমিটেডের ম্যানেজিং এজেণ্ট! তিনি সম্প্রতি এক খানি বাংলা সাময়িক পত্রে “বাংলার অন্তর্বাণিজ্যে বাঙালীর স্থান” শীর্ষক কয়েকটি প্রবন্ধ লিখিয়াছেন। তিনি যে চিত্র আঁকিয়াছেন, তাহা অতীব শোচনীয়। আমি নিম্নে তাহা হইতে কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।
‘৩৫ বৎসর পূর্বে ঘৃত ও চিনির ব্যবসা—প্রধানতঃ বাঙালীদের হাতেই ছিল। বর্তমানে মাড়োয়ারীরা তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে স্থানচ্যুত করিয়াছে। পেঁয়াজের ব্যবসাতেও বাঙালী তাহার স্থান হারাইয়াছে। বোম্বাই, মাদ্রাজ, এবং বিহার প্রদেশ হইতে যে পেঁয়াজ আমদানী হয়, তাহা অবাঙালীদেরই একচেটিয়া; বাংলায় উৎপন্ন পেঁয়াজও অবাঙালীদেরই হস্তগত। ৮।১০ বৎসর পূর্বেও বেলেঘাটায় (কলিকাতা) ১৫। ১৬টি পেঁয়াজের গুদাম ছিল, বর্তমানে ঐ স্থানে মাত্র ৭।৮টি পেঁয়াজের গুদাম আছে। গম বাঙালীর খাদ্য দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া পড়িতেছে। অন্ততঃপক্ষে অবস্থাপন্ন বাঙালীরা উহা খায়। এই গমের ব্যবসা—অবাঙালীদের, প্রধানতঃ মাড়োয়ারীদের, হস্তগত। কলিকাতার অলিগলিতে বৈদ্যুতিক শক্তি পরিচালিত বহু ছোট ছোট আটা ভাঙ্গার কল আছে। ঐ গুলি অশিক্ষিত হিন্দুস্থানীদের। তাহারা প্রথমে হয়ত সামান্য শ্রমিক বা মজুর রূপে কলিকাতায় আসিয়াছিল। ইহা ছাড়া কলিকাতায় তিনটি বড় আটার কল আছে, উহার প্রত্যেকটিতে দৈনিক প্রায় আট শত মণ আটা ভাঙ্গা হয়। এই তিনটির মধ্যে মাত্র একটি কল বাঙালীর। ময়দার ব্যবসাও সম্পূর্ণ রূপে অবাঙালীদের হাতে। এই ময়দা কলিকাতা হইতে বাংলার মফঃস্বলে সর্বত্র চালান হয়। প্রত্যহ বিহার ও যুক্ত প্রদেশ হইতে গাড়ী গাড়ী ডাল আমদানী হইতেছে। এই ব্যবসাও অবাঙালীদের হাতে। কলিকাতায় আহিরীটোলা অঞ্চলে ডালের বড় বড় আড়ত আছে। এগুলিও হিন্দুস্থানীদের হাতে। তৈল বীজের ব্যবসাতেও অবাঙালীদের একচেটিয়া অধিকার। সরিষার তৈল বাঙালীদের একটি প্রধান খাদ্য, অবস্থাপন্ন লোক ছাড়া অন্য লোকে সাধারণতঃ ঘি ব্যবহার করিতে পারে না। বাংলার পাঁচ কোটী অধিবাসীর মধ্যে বোধ হয় দশ লক্ষ লোক ঘি ব্যবহার করিতে পারে। ত্রিশ বৎসর পূর্বেও এই সরিষার তৈল এবং অন্যান্য তেলের কল বাঙালীদের ছিল। এখন এই গুলি অবাঙালীদের হাতে চলিয়া