পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩৩৩

 “দেখা যাইবে, মধ্যবিৎ সম্প্রদায়ের বাঙালীদের জীবিকার ক্ষেত্র এখন তাহাদের পূর্ব পুরুষদের চেয়ে বিস্তৃত। তৎসত্ত্বেও তাহারা কেবল কতক গুলি বিশেষ শ্রেণীর জীবিকাই পছন্দ করে। সাধারণ ভদ্রলোক এমন কাজ করিতে চায় না,—যাহাতে লেখাপড়ার প্রয়োজন হয় না। সে অল্প বেতনের কেরাণীগিরি সাগ্রহে গ্রহণ করিবে অথবা ওকালতী ব্যবসায়ে ভিড় জমাইবে; কিন্তু মুদী, ঠিকাদার অথবা পুরোনো মালের ব্যবসায়ী হইবার কল্পনা সে করিতে পারে না। অশিক্ষিত অথচ ঐশ্বর্যশালী হিন্দুস্থানীদের অবলম্বিত ব্যবসায়ের প্রতি তাহার ঘোর অবজ্ঞা,—কিন্তু সে ঐ সব অশিক্ষিত ব্যবসায়ীদের অধীনেই কেরাণীগিরি করিতে বিন্দুমাত্র আপত্তি করে না। নিতান্ত কষ্টে পড়িলে সে কোন ‘অশিক্ষিতের ব্যবসা’ অবলম্বন করিতে পারে, কিন্তু তখনও সে এমন ব্যবসা বাছিয়া লইবে যাহা অপেক্ষাকৃত নূতন এবং নিম্নজাতীয় লোকদের পৈতৃক ব্যবসা নয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সে মোটর ড্রাইভার, ঘড়ি মেরামতকারী অথবা যান্ত্রিকও হইতে পারে, কিন্তু দর্জী, ছুতার বা কামারের কাজ কখনই করিবে না।

 “ইহার অবশ্য ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু উপরে যাহা বলিলাম, সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর পক্ষে তাহা মোটামুটি খাটে। নিম্ন স্তর হইতে লোকের আমদানী হইয়া এই মধ্যবিৎ শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি করিতেছে এবং প্রতিযোগিতায় ভদ্র জীবনের আদর্শ উচ্চ হইতে উচ্চতর হইতেছে। এই শ্রেণীর লোক মাত্র কতকগুলি জীবিকা পছন্দ করে, কিন্তু তাহাতে সকলের স্থান সঙ্কুলান হইতে পারে না। সেকালে এক এক জন উপার্জনশীল ব্যক্তি বহু দরিদ্র ও বেকার আত্মীয়দের ভরণপোষণ করিতেন। কিন্তু জীবিকার আদর্শ বাড়িয়া যাওয়াতে উপার্জনশীল ব্যক্তিদের নিজেদের কথাই বেশী চিন্তা করিতে হয়। দরিদ্র আত্মীয়দের কথা তাঁহারা ভাবিতে পারেন না। ফলে যৌথ পরিবার প্রথা ভাঙ্গিয়া যাইতেছে, এবং যৌথ পরিবারভুক্ত বহু ব্যক্তি অলস জীবন যাপন অসম্ভব দেখিয়া কাজ খুঁজিতে বাধ্য হইতেছে।

বর্তমান বেকার অবস্থার কারণ

 “প্রধান কারণ গুলি এই ভাবে বিভক্ত করা যাইতে পারে:—

 (১) মধ্যবিৎ শ্রেণীর লোকদের বিশেষ কতকগুলি জীবিকার প্রতি আসক্তি; যথা, (ক) ডাক্তারী, ওকালতী, প্রভৃতি ‘বিদ্বৎ ব্যবসা’; (খ) যে সব কাজে স্কুল কলেজের শিক্ষা প্রয়োজনীয়; (গ) যে সব কাজের সঙ্গে নিম্ন জাতির নাম জড়িত নহে।

 (২) নূতন বৃত্তি শিখিবার সুযোগের অভাব,—নূতন জীবিকার অভাব।

 (৩) ব্যবসায়ীদের সহিত সংস্পর্শ না থাকার দরুণ ব্যবসা বাণিজ্যে অজ্ঞতা।

 (৪) যৌথ পরিবার প্রথা ভাঙ্গিয়া যাওয়ায় বহু বেকার লোকের সৃষ্টি।

 (৫) নিম্ন স্তর হইতে বহু লোক আমদানী হইয়া মধ্যবিৎ শ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছে; এই সব নূতন লোকের মনোবৃত্তি ভদ্রলোকদেরই মত।

 (৬) বিদেশী এবং ভারতের ভিন্ন প্রদেশ হইতে আগত লোকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা। উহারা চরিত্র ও অভ্যাসের গুণে, বাঙালীদের চেয়ে ব্যবসা বাণিজ্যে বেশী যোগ্যতা প্রদর্শন করে।

প্রতিকারের উপায়

 “এইরূপে প্রায়ই বলা হইয়া থাকে যে, গবর্ণমেণ্ট বা বিশ্ববিদ্যালয় যদি ব্যাপক ভাবে বৃত্তি শিক্ষার ব্যবস্থা করেন, তাহা হইলেই এই বেকার সমস্যার সমাধান হইতে পারে।