‘বিদ্বৎ ব্যবসা’ (ওকালতী, ডাক্তারী প্রভৃতি) শিখাইবার সুবন্দোবস্ত আছে। বাঙালীদের মধ্যে আইন শিক্ষা বরং অতিরিক্ত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু ডাক্তারী ও ইঞ্জিনীয়ারিং শিক্ষার এখনও অবসর আছে। কিন্তু এই সব বৃত্তি কেবল স্বল্পসংখ্যক উচ্চশিক্ষিতদেরই যোগ্য। যাহাদের যোগ্যতা মধ্যম রকমের, তাহাদের জন্য হিসাব রাখা, স্টেনোগ্রাফী ও কেরাণীর কাজ শিখাইবার কয়েকটি স্কুল আছে। কৃষি, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, জরীপ বিদ্যা, অঙ্কন বিদ্যা, মোটর গাড়ীর ড্রাইভারী ও মেরামতের কাজ, টেলিগ্রাফ সিগন্যালিং, তাঁতের কাজ, চামড়ার কাজ এবং এই শ্রেণীর অন্যান্য বৃত্তি শিখাইবার জন্যও কয়েকটি স্কুল আছে। এই সব স্কুল ভাল কাজ করিতেছে এবং এইগুলির সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। মাধ্যমিক শিক্ষার সঙ্গে কার্যকরী শিক্ষা দান করিবারও প্রস্তাব হইয়াছে। কিন্তু যে সব বিষয় শিখাইবার প্রস্তাব সাধারণতঃ করা হয়, তাহার মধ্যে বৈচিত্র্য নাই, যথা,—ছুতারের কাজ, প্রাথমিক যন্ত্রবিদ্যা এবং বড় জোর সূতা কাটা ও বুননের কাজ। অবশ্য, এ সব বিষয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলা যায় না,—ছেলেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, কর্মকুশলতা শিখানোই যদি ইহার উদ্দেশ্য হয়। কিন্তু ছেলেরা এই শিক্ষার ফলে সাধারণ শ্রমশিল্পীর জীবিকা গ্রহণ করিবে, ইহা যদি কেহ আশা করেন, তাহা হইলে তিনি ‘ভদ্রলোকদের’ প্রকৃতি জানেন না। কেহ কেহ বলেন যে, আধুনিক যুগের শিল্পাদি সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক শিক্ষা দিবার জন্য কলেজের সঙ্গে টেকনোলজিক্যাল ক্লাস খুলিতে হইবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এদেশে এখনও শিল্প কারখানা প্রভৃতি বেশী গড়িয়া উঠে নাই। সতরাং এরূপ লোকের চাহিদা খুবই কম। ছাত্রেরা কলেজে ‘বৈজ্ঞানিক শিক্ষা’ সমাপ্ত করিয়া নিজেরা শিল্প কারখানা প্রভৃতি খুলিবে, এরূপ আশা করা ভ্রম। কলেজের ক্লাসে শিক্ষা লাভের দ্বারা ব্যবসা গড়িয়া তোলা যায় না। কয়েকজন উৎসাহী ও উদ্যোগী ছাত্র এই ভাবে শিক্ষা লাভ করিয়া ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করিতে পারে, কিন্তু অধিকাংশ স্থলে নবশিক্ষিত শিল্পবিৎ (টেকনোলজিষ্ট) যথাযোগ্য সমর্থন না পাইয়া ব্যবসায়ে নামিলে, উহাতে সাফল্য লাভ করিতে পারিবে না।
“সুতরাং এখন কর্তব্য কি? ভবিষ্যতের আশায়, ছেলেদের শিল্প, কার্যকরী বৃত্তি প্রভৃতি শিক্ষা দিবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা হোক, আপত্তির কারণ নাই। কিন্তু বর্তমান বংশীয়েরা যেন এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস পোষণ না করে যে, ‘টেকনিক্যাল’ শিক্ষার দ্বারাই সকল সমস্যার সমাধান হইবে, যেমন তাহাদের পূর্বগামীরা মনে করিত যে, সাধারণ স্কুল ও কলেজে শিক্ষালাভই জীবিকা সংস্থানের নিশ্চিত উপায়। যুবকদের বুঝা উচিত যে, পণ্য উৎপাদনের উপায় জানা ভাল বটে, কিন্তু পণ্য বিক্রয় করিতে জানাই অনেক স্থলে বেশী লাভজনক। বাংলার বাহির হইতে যে হাজার হাজার লোক আমদানী হইয়াছে, তাহাদের কার্যকলাপের প্রতি মধ্যবিৎ বাঙালীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। এই সব লোকের স্বাভাবিক ব্যবসাবুদ্ধি ও সাহস ছাড়া অন্য কোন মূলধন নাই এবং ইহারই বলে তাহারা বাংলার সুদূর প্রান্ত পর্যন্ত আক্রমণ করিয়াছে এবং এদেশের অন্তর্বাণিজ্য হস্তগত করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জন করিতেছে।
“বিদ্বৎব্যবসা ও কেরাণীগিরির প্রতি ভদ্রলোকদের অস্বাভাবিক মোহ ঘুচাইতে হইবে। তাহাদিগকে ব্যবসার সর্বপ্রকার রহস্য শিখাইতে হইবে। কোন একটা অজ্ঞাত জীবিকার সম্বন্ধে যে ভয় ও ঘৃণার ভাব, ভদ্র যুবকদের মন হইতে যখন তাহা দূর হইবে, তখন তাহারা দেশের বিশাল ব্যবসাক্ষেত্রে নিজেদের স্থান করিয়া লইতে পারিবে। যে খুচরা দোকানী অথবা ঠিকাদার হইতে পারে, শিল্পী ও মজুরদের খাটাইতে পারে, বড় ব্যবসায়ী ও খুচরা দোকানদারের মধ্যবর্তী ব্যবসায়ী হইতে পারে, সে ছোট দোকানদাররূপে কাজ আরম্ভ করিয়া নিজের অধ্যবসায় বলে বড় ব্যবসায়ী হইতে পারে। মিঠাইওয়ালা বা মুদীর ব্যবসায়ের মত ক্ষুদ্র