পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩৩৫

কাজও পরিত্যাগ করা তাহার পক্ষে উচিত নহে। তাহার শিক্ষা ও মার্জিত রুচি কাজে খাটাইয়া সে তাহার গ্রাহকদের অধিকতর সন্তুষ্ট করিতে পারে, তাহার ক্ষুদ্র দোকানই সকলের নিকট আকর্ষণের বস্তু হইয়া উঠিতে পারে।

 “এইরূপে মনোবৃত্তি তাড়াতাড়ি সৃষ্টি করা যায় না। সংস্কারের বাধা অতিক্রম করিয়া মধ্যবিৎ শ্রেণীদের ব্যবসা বাণিজ্য শিখাইতে একটু সময় লাগিবে। ট্রেনিং ক্লাস কোন ব্যবসায়ের প্রাথমিক সূত্রগুলি শিখাইতে পারে মাত্র। কিন্তু যাহারা ব্যবসায়ে নিযুক্ত আছে, তাহাদের সঙ্গে কাজ করিয়াই কেবল ব্যবসায় জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভবপর। অধিকাংশ ব্যবসায়ের জন্য স্কুলে শিক্ষা লাভ করা যায় না। স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি সীমাবদ্ধ, তাহাদের নিকট বেশী আশা করা অনুচিত। পারিবারিক আবহাওয়া এমন ভাবে বদলাইতে হইবে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর প্রতি অতিরিক্ত মোহ যেন না থাকে। যুবকরা এখন বুঝিতে পারিয়াছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রী জীবন সংগ্রামে বেশী কিছু সাহায্য করিতে পারে না। তবুও তাহারা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সে কেবল উপায়ান্তর রহিত হইয়া,—বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া ছাড়িলেই তাহাদিগকে কোন একটা জীবিকার উপায় অবলম্বন করিতে হইবে, এই আশঙ্কায়। বাছা বাছা মেধাবী ছাত্রদের জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীগুলি থাকুক। সাধারণ যুবকেরা নিজেদের শক্তি ও পিতামাতার অর্থ লক্ষ্যহীন কলেজী শিক্ষায় অপব্যয় না করিয়া, ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা পাশ করিবার পর কোন ব্যবসায়ীর অধীনে কয়েক বৎসর শিক্ষানবিশী করিলে অনেক বেশী লাভবান হইবে।”

 শ্রীতে বসরে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা হইতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধির অস্বাভাবিক মোহ সম্বন্ধে তিনি যে সব কথা বলিয়াছেন, তাহা বিশেষরূপে অনুধাবনযোগ্য। আমাদের যুবকেরা ঘটনাস্রোতে যেন লক্ষ্যহীন ভাবে ভাসিয়া চলিয়াছে এবং একবারও চিন্তা করে না কি আত্মহত্যাকর নীতি তাহারা অনুসরণ করিতেছে। এজন্য তাহাদের অভিভাবকরাই বেশী দায়ী।

 আমাদের যুবকেরা বি. এ. বা বি. এসসি. পাশ করিলেই এম. এ. বা এম. এস-সি পড়িতে আরম্ভ করে, কঠোর সংগ্রামের সম্মুখীন হইবার বিপদ যতদিন পারে, এড়াইবার জন্য। তাহারা ভুলিয়া যায় যে, এই উচ্চ শিক্ষার যত উচ্চতর ধাপে তাহারা উঠিবে, জীবন সংগ্রামে ততই তাহারা বেশী অপটু ও অসহায় হইবে।

 হ্যাজলিট The Ignorance of the Learned—(বিদ্বান্‌দের অজ্ঞতা) শীর্ষক একটি প্রবন্ধে বলিয়াছিলেন,—“যাহারা ক্লাসিক্যাল এডুকেশান (উচ্চ শিক্ষা) সমাপ্ত করিয়াও নির্বোধ হয় নাই, তাহারা নিজেদের ভাগ্যবান মনে করিতে পারে। পণ্ডিত ব্যক্তি জীবনের বাস্তব কার্যক্ষেত্রে নামিয়া চারিদিকে নানা বাধা ও অসুবিধা অনুভব করে।”

 এইরূপে হতভাগ্য ডিগ্রীধারীরা নিজেদের যেন অজ্ঞাত দেশে অসহায় শিশুর মত বোধ করে।

 আমি পূর্বে বলিয়াছি যে, যাহারা জানার্জনে সত্যকার প্রেরণা বোধ করে, কেবল তাহাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করা উচিত।

 কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এস-সি. পরীক্ষা শেষ হইয়াছে (৯ই আগষ্ট, ১৯৩২)। রসায়ন শাস্ত্রে ২১ জন, পদার্থবিজ্ঞানে ১৭ জন, বিশুদ্ধ গণিতে ৩৮ এবং ব্যবহারিক গণিতে ৩৫ জন পরীক্ষা দিতে গিয়াছিল। তন্মধ্যে রসায়নে ১১ জন দুই একদিন পরীক্ষা দিয়াই চলিয়া আসিয়াছে, পদার্থবিজ্ঞানেও ১০ জন ঐরূপ করিয়াছে; বিশুদ্ধ গণিতে ৯ জন চলিয়া আসিয়াছে এবং ব্যবহারিক গণিতে ১১ জন (তাহারা সকলেই নিয়মিত ছাত্র) প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের পর আর পরীক্ষা দেয় নাই। মোট ১১১ জনের ৪০ জন শেষ পর্যন্ত