পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম পরিচ্ছেদ

তাহার ফলেই বোধ হয় ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ প্রবর্তক লর্ড কর্ণওয়ালিস ভারতবাসীদিগকে সমস্ত সরকারী উচ্চ পদ হইতে বঞ্চিত করিয়াছিলেন। এই পন্থা অবলম্বন করিবার স্বপক্ষে বাহ্যতঃ সঙ্গত কারণও যে তাঁহার ছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। শোভাবাজার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ (পরে রাজা নবকৃষ্ণ) রবার্ট ক্লাইভের মুন্সী ছিলেন এবং মাসিক ষাট টাকা মাত্র বেতন পাইতেন। কিন্তু তিনি নিজের মাতৃশ্রাদ্ধে নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। তখনকার দিনের নয় লক্ষ টাকা এখনকার অর্ধকোটী টাকার সমান। ওয়ারেন হেষ্টিংসের দেওয়ান, পাইকপাড়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিং প্রভূত বিত্ত সঞ্চয় করেন এবং প্রাচীন জমিদারদের উৎখাত করিয়া বড় বড় জমিদারী দখল করেন। কান্ত মুদী নিজের জীবন বিপন্ন করিয়া তাঁহার কাশিমবাজারের ক্ষুদ্র দোকানে ওয়ারেন হেষ্টিংসকে আশ্রয় দেন। ওয়ারেন হেষ্টিংস যখন বাঙ্গলার শাসক হন, তখন তাঁহার আশ্রয়দাতাকে ভুলেন নাই। হেষ্টিংস তাঁহার পুরাতন উপকারী বন্ধুকে খুঁজিয়া বাহির করেন এবং অনেক জমিদারী তাঁহাকে পুরস্কার দেন। এই সমস্ত জমিদারী ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর অসম্ভব দাবী মিটাইতে না পারিয়া হতভাগ্য পুরাতন মালিকদের হস্তচ্যুত হইয়া গেল। এখানে গঙ্গাগোবিন্দ সিং এবং নসীপুরের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দেবী সিংহের অত্যাচার-কাহিনী বর্ণনা করিবার প্রয়োজন নাই। বার্কের Impeachment of Warren Hastings গ্রন্থের পাঠকদের নিকট তাহা সুপরিচিত।

 কর্ণওয়ালিসের আমল অন্য অনেক বিষয়ে ভাল হইলেও, উচ্চপদ হইতে ভারতবাসীদিগকে বহিষ্কার তাহার একটি কলঙ্ক। পূর্বে যাহা বলিয়াছি, তাহাতে কেহ কেহ মনে করিতে পারেন যে, আমি কর্ণওয়ালিসের এই নীতির সাফাই গাহিতেছি।[১] আমার উদ্দেশ্য মোটেই তাহা নয়। বস্তুতঃ রোগ অপেক্ষা ঔষধই মারাত্মক হইয়া দাঁড়াইল। ব্রিটিশ সিভিলিয়ান কর্মচারীরা এদেশের লোকের ভাষা, আচার ব্যবহার, সামাজিক প্রথা কিছুই


  1. এ বিষয়ে মার্শম্যান ও সার হেনরী ষ্টাচীর উক্তি উল্লেখযোগ্য:
    “লর্ড কর্ণওয়ালিসের আমল হইতে আমাদের শাসনে এক দূরপনেয় কলঙ্কের মসী লিপ্ত হইয়া আছে; আমাদের সাম্রাজ্যের যত শ্রীবৃদ্ধি হইতেছে, দেশের মধ্যে যাহারা প্রভাব প্রতিপত্তিশালী তাহাদের আশা ভরসায় ততই ছাই পড়িতেছে; আমাদের শাসন ব্যবস্থায় তাহাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কোনও স্থান নাই। আপন দেশে তাহারা দুর্গতির হীনতম স্তরে অবস্থান করিতেছে।”
     “একটা সমগ্র জাতির এরূপ অপাংক্তেয় অবস্থার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে আর দেখা যায় না। যে গল জাতি সীজারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিয়াছিল তাহাদেরই বংশধরগণ রোমের রাষ্ট্রসভায় সদস্যপদ লাভ করিয়াছিল। যে রাজপুত বীরগণ বাবরের মোগলশক্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে অঙ্কুরেই বিনষ্টপ্রায় করিয়াছিল তাহাদেরই পুত্রপৌত্রাদি আকবরের আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তা ও সেনাপতির পদ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন এবং প্রভুর হিতে বঙ্গোপসাগর ও অক্‌সাস নদীর তীরে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করিয়াছিল। এমন কি, মুসলমান সুবাদারগণের ষড়যন্ত্রে যখন আকবর বিপন্ন, তখন এই রাজপুতগণই অবিচলিত নিষ্ঠা ও রাজভক্তি সহকারে তাঁহার সিংহাসন নিরাপদ রাখিয়াছিল, কিন্তু ভারতের যে অংশেই আমাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে সেখানেই দেশবাসীদের পক্ষে উচ্চাভিলাষ, ক্ষমতা, যশ, অর্থ, সম্মান বা যে কোন প্রকার উন্নতির পথ চিররুদ্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে। ইহারই পাশাপাশি দেশীয় নৃপতিগণের সভায় ছিল যোগ্যতা ও গুণের প্রচুর সমাদর—সতরাং তুলনায় এই বৈষম্য বড়ই বিসদৃশ লাগিত।”—মার্শম্যানের ভারতেতিহাস।
     “কিন্তু ইউরোপীয়ান কর্মচারীদিগকে আমরা প্রলোভনের বহু ঊর্দ্ধে রাখিয়াছি। যে সকল দেশীয় কর্মচারীর পূর্বপুরুষগণ, উচ্চ ও সম্ভ্রান্ত পদে থাকিয়া দশজনের উপর কর্তৃত্ব করিতে অভ্যস্ত ছিলেন, তাঁহাদিগকে আমরা বিশ ত্রিশ টাকা বেতনে সামান্য কেরাণীর কাজে নিযুক্ত করিয়াছি। ইহার পর আমরা বলিয়া বেড়াই যে, ভারতীয়েরা অসাধু ও ঘুসখোর এবং একমাত্র ইউরোপীয় কর্মচারিগণই তাহাদের প্রভু হইবার যোগ্য।”—সার হেনরী স্ট্যাচী।