পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সপ্তবিংশ পরিচ্ছেদ
৩৩৭

 বাংলার দুর্ভাগ্য এই যে, সে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের সর্বত্রই নিজেকে পরাস্ত হইতে দিয়াছে। কয়েক জন আইনজ্ঞ এবং উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরিয়া ব্যতীত তাহার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, অর্দ্ধাহারক্লিষ্ট স্বল্পবেতনের কেরাণী ও স্কুল মাষ্টারে পরিণত হইয়াছে। আর তাহার দৌর্বল্য ও অক্ষমতার সুযোগ লইয়া, শক্তিশালী, উৎসাহী অ-বাঙালী ব্যবসায়ীরা সমস্ত ধনাগমের পথ দখল করিয়াছে। বিদেশী বা অ-বাঙালীর নিকট বাংলা দেশ অর্থোপার্জনের একটা বিশাল ক্ষেত্র, তাহারা এখানে প্রচুর উপার্জন করে। আর বাঙালীরা এখানে সেখানে এক মুঠা অন্নের জন্য ভিক্ষাবৃত্তি করিয়া বেড়াইতেছে।

 দেশের রপ্তানী ও আমদানী বাণিজ্যের বিস্তৃতির সঙ্গে এমন কি অন্তর্বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে তাল রাখিয়া চলিতে না পারিয়া বাঙালীর চরিত্রের অধোগতিও হইতেছে। একজন স্বাবলম্বী ব্যবসায়ীর চরিত্রের সমস্ত দিক আশ্চর্যরূপে বিকাশপ্রাপ্ত হয়। তাহার কর্মক্ষমতা ও শাসন শক্তি বাড়িয়া যায়। সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠাতাদের সঙ্গে তাহার চরিত্রের অল্প বিস্তর সাদৃশ্য আছে। কিন্তু একজন আইনজীবী, কেরাণী অথবা স্কুল মাষ্টার, নিজ নিজ ক্ষেত্রে যতই কৃতী হউক,—যখনই নিজের এলাকার বাহিরের কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়, তখনই সে ঘোর অজ্ঞতার পরিচয় প্রদান করে। এ ক্ষেত্রে সে একেবারে শিশুর মত সরল ও অজ্ঞ। তাহার দৃষ্টিও অতি সঙ্কীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। এক কথায় নিজের সংঙ্কীর্ণ সীমার বাহিরে আসিলেই তাহার অবস্থা শোচনীয় হয়। কয়েক বৎসর ভারতীয় ব্যবস্থাপরিষদে বাংলার প্রতিনিধিরা একেবারে নগণ্য হইয়া পড়িয়াছেন,—নিরপেক্ষ দর্শকদের এই মত। অর্থনীতি বিষয়ে কোন আলোচনা উপস্থিত হইলেই বাংলার প্রতিনিধিরা চাণক্যের উপদেশ স্মরণ করিয়া নীরব থাকাই শ্রেয়ঃ জ্ঞান করে—“দূরতো শোভতে মূর্খঃ যাবৎ কিঞ্চিন্ন ভাষতে।”

 দালাল, পুরুষোত্তম দাস ঠাকুর দাস, কল্যাণজী নারায়ণজী, বালচাঁদ হীরাচাঁদ, ডেভিড সেসুন, বিড়লা অথবা খৈতান প্রভৃতি ব্যবসা জগৎ অথবা টাকার বাজারের সংস্পর্শে থাকাতে, জটিল অর্থনীতি বিষয়ে মতামত জ্ঞাপনে স্বভাবতই বেশী যোগ্যতা প্রদর্শন করেন। আমাদের কলেজের অর্থনীতির বাঙালী অধ্যাপক কেবল পাখিপড়া পণ্ডিত, ব্যবহারিক জ্ঞান তাহার কম। এক জন কলেজে শিক্ষিত ব্যক্তি “রিভার্স কাউন্সিল বিল” সম্বন্ধে সঠিক মত দিতে পারে না।—তা ছাড়া, একজন ধনী ব্যবসায়ীর পক্ষে সাহসের সঙ্গে নিরপেক্ষ স্বাধীন মত ব্যক্ত করা সহজ। উপরওয়ালাদের ভ্রূকুটী বা অনুগ্রহে সে বিচলিত হয় না। সে দুই কুল বজায় রাখিবার চেষ্টা করে না, বা সময় বুঝিয়া নিজের মত পরিবর্তন করে না। পক্ষান্তরে কেরাণী, চাকরীজীবী এবং অনুগ্রহপ্রার্থীর দল স্বভাবতই দাস মনোবৃত্তির দ্বারা চালিত হয়। তোষামোদ এবং পরনিন্দাতে সে পাকা হইয়া ওঠে, তাহার চরিত্রের অধোগতি হয়।

 অদ্ভূত বোধ হইলেও, একথা সত্য যে, বাঙালী সাহিত্য ও বিজ্ঞানে যতই মৌলিক গবেষণা করিতেছে, ততই জীবিকা সংগ্রহে সে অক্ষমতা প্রদর্শন করিতেছে। কেহ তাহাকে শিক্ষানবিশ রূপে লইতেও সাহস পায় না, কেননা সে বড় বড় কথা বলে। সে নিজেও নিম্ন স্তর হইতে শিক্ষানবিশী আরম্ভ করিতে অনিচ্ছুক। সাধারণ কলেজে শিক্ষিত যুবক মনে করে যে, ব্যবসায়ী হইতে হইলে তাহার সেক্রেটেরিয়েট টেবিল, বৈদ্যুতিক পাখা এবং মোটর গাড়ী চাই। সে আশা করে প্রথম হইতেই তাহার জন্য সর্বপ্রকার আরাম ও সুবিধা প্রস্তুত হইয়া থাকিবে, ফলে শেষ পর্যন্ত সে স্বল্পবেতনের কেরাণী জীবন যাপন করিতে বাধ্য হয় অথবা আত্মহত্যা করিয়া সমস্ত সমস্যার মীমাংসা করে।