পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ

জাতিভেদ—হিন্দু সমাজের উপর তাহার অনিষ্টকর প্রভাব

(১) এক দিকে শিক্ষিত ও মার্জিতরুচি সম্প্রদায়, অন্য দিকে

কৃষক, শিল্পী ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে সামাজিক প্রভেদ

ও অন্তরায়—পারিবারিক কলহের কারণ

 বংশানুক্রমের প্রভাব সম্বন্ধে অনেক কথাই বলা হইয়াছে, মানিয়া লওয়াও হইয়াছে। জাতিভেদ-পীড়িত ভারতেও এমন কতক গুলি প্রমাণ পাওয়া যায়, যাহাতে মনে হয় যে, কতক গুলি বিশিষ্ট গুণ বংশানুক্রমিক। বর্তমান ভারতে পাশ্চাত্য ভাব ও শিক্ষা বিস্তারের পর, পুনা ও মাদ্রাজের ব্রাহ্মণ, বাংলার ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ, এবং যুক্ত প্রদেশের অধিবাসী কাশ্মীরী পণ্ডিতদের মধ্য হইতেই সাহিত্য, সমাজ ও রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের উদ্ভব হইয়াছে। স্যার টি. মাধব রাও, রঙ্গ চার্লু, বিচারপতি মুথুস্বামী আয়ার, ভাশ্যাম আয়েঙ্গার, প্রসিদ্ধ গণিতজ্ঞ রামানুজম, রামমোহন রায়, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বিচারপতি দ্বারকানাথ মিত্র, কেশব চন্দ্র সেন, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্য বহু প্রধান ব্যক্তির আবির্ভাব এই কথাই প্রমাণিত করে। জাতিভেদ প্রথার অসুবিধা ও তাহার গুরুতর ত্রুটীও ইহাতে সম্পষ্ট ধরা পড়ে। বাংলার পাঁচ কোটী লোকের মধ্যে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থের সংখ্যা প্রায় ২৫ লক্ষ মাত্র—অর্থাৎ তাহারা সমগ্র লোকসংখ্যার শতকরা ৫ ভাগ মাত্র। অপর পক্ষে, ইংলণ্ডে সাধারণ শ্রেণীর মধ্য হইতে উদ্ভূত একজন চার্চিল ব্লেনহিমের যুদ্ধে কৃতিত্ব প্রদর্শন করিয়া ডিউক পদবীতে উন্নীত হন,—একজন পিট আর্ল অব চ্যাথাম হইতে পারেন। সাহিত্য জগতে একজন কসাইএর পুত্র “রবিনসন ক্রুসো”র প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার হন,—জেলের একজন হীন ব্যবসায়ী “পিলগ্রিম্‌স প্রোগ্রেস”[] বই লিখিতে পারেন। ফ্রান্সেও এইরূপ দৃষ্টান্ত


  1. ইংলণ্ডের সিভিল ওয়ার বা গৃহযুদ্ধের সময়ে সাধারণ শ্রেণীর মধ্য হইতে যে সব বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্ভব হইয়াছিল, বাক্‌ল তাঁহাদের একটি তালিকা দিয়াছেন। উহা হইতে আমরা কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি:
     “বড় বড় পাদরী, কার্ডিনাল বা আর্কবিশপ প্রভৃতি দ্বারা যেমন ‘রিফর্মেশানের’ সহায়তা হয় নাই, সমাজের নিম্ন স্তরের সাধারণ লোকদের দ্বারাই হইয়াছে, ইংলণ্ডের বিদ্রোহও তেমনি সমাজের নিম্ন স্তরের অতি সাধারণ লোকদের দ্বারাই হইয়াছে। যে ২।৪ জন উচ্চপদস্থ লোক জনসাধারণের পক্ষে যোগ দিয়াছিলেন, তাঁহারা শীঘ্রই পরিত্যক্ত হইয়াছিলেন এবং যেরূপ দ্রুতবেগে তাঁহাদের পতন হইয়াছিল, তাহাতেই বুঝা গিয়াছিল, হাওয়া কোন দিকে বহিতেছে। যখন অভিজাতবংশীয় সেনাপতিদিগকে বিতাড়িত করিয়া নিম্ন স্তরের মধ্য হইতে সেনাপতিদের নিযুক্ত করা হইল, তখনই ভাগ্যের পরিবর্তন আরম্ভ হইল, রাজতন্ত্রবাদীরা সর্বত্র পরাস্ত হইতে লাগিলেন।...ঐ যুগে দরজী ও শ্রমিকেরাই সাধারণের কাজ চালাইবার যোগ্য বিবেচিত হইল এবং রাষ্ট্রক্ষেত্রে তাহারাই প্রধান স্থান গ্রহণ করিল।...সেই সময়ের তিন জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ভেনার, টাফনেল এবং ওকে। ইঁহাদের মধ্যে যিনি নেতা, সেই ভেনার ছিলেন মদ্য ব্যবসায়ী, তাঁহার সহকারী টাফনেল ছিলেন সূত্রধর, এবং কর্নেলের পদে উন্নীত হইলেও, ওকে ইসলিংটনের একটি মদের কারখানার স্টোরকিপারের কাজ করিতেন।
     “এগুলি ব্যতিক্রম নয়। ঐ যুগে লোকের যোগ্যতার উপরই তাহাদের উচ্চ পদ লাভের সম্ভাবনা নির্ভর করিত এবং কোন লোক যোগ্য হইলে তাহার জন্ম যে কুলেই হোক, যেরূপ ব্যবসায়েই সে