পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৪০
আত্মচরিত

শিক্ষকতা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন, তবু, তিনি তাঁহার পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করেন নাই। তাঁহার পড়িবার আগ্রহ পূর্বের মতই ছিল এবং শারীরিক শ্রমের কাজের পর বিশ্রামের সময় তিনি বই পড়িতেন।”[] তিনি তাঁহার বিধবা এবং দুইটি শিশু সন্তানকে রাখিয়া পরলোক গমন করেন। লয়েড জর্জের বয়স তখন দুই বৎসর মাত্র। লয়েড জর্জের মাতুল অবিবাহিত এবং দরিদ্র জুতা নির্মাতা ছিলেন, তিনি তাঁহার বিধবা ভগ্নী ও ভাগিনেয়দের ভার গ্রহণ করিলেন। এই মাতুলও জুতা সেলাই কাজের অবসরে অধ্যয়ন করিতে ভাল বাসিতেন।

 বার্নস গরীব চাষার ছেলে ছিলেন। কার্লাইল বলেন, “বার্নসের পিতা একজন চরিত্রবান কৃষক ছিলেন, কিন্তু তিনি এমন গরীব ছিলেন যে, ছেলেমেয়েদের একালের স্বল্পব্যয়সাধ্য স্কুলে পাঠাইয়াও লেখাপড়া শিখাইতে পারেন নাই এবং বার্নসকে বাল্যকালে লাঙলের কাজ করিতে হইত।” বিভিন্ন কৃষকের ফার্মে কাজ করিয়া বার্নস সেই দারিদ্রের মধ্যেই বাস করিতে লাগিলেন। তের বৎসর বয়সে, তিনি স্বহস্তে শস্য মাড়াইতেন। ১৫ বৎসর বয়সে তিনি প্রধান মজুরের কাজ করিতেন। স্কুলে গিয়া তিনি তাঁহার স্বল্প অবসরের মধ্যে প্রবল আগ্রহের সঙ্গে পড়িতে লাগিলেন। আহারের সময় তাঁহার এক হাতে চামচ, অন্য হাতে বই থাকিত। ক্ষেতে কাজ করিতে যাইবার সময়ও তিনি সঙ্গে কয়েক খানি বই লইয়া যাইতেন এবং অবসর সময়ে পড়িতেন।

 মাইকেল ফ্যারাডে কর্মকারের ছেলে ছিলেন এবং প্রথম বয়সে দপ্তরীর দোকানে শিক্ষানবিশি করিতেন এবং অতি কষ্টে সামান্য আহারে জীবন ধারণ করিতেন।

 কবি জেমস হগ নিয়মিত ভাবে শিক্ষা লাভ করিতে পারেন নাই। তাঁহাকে প্রায়ই স্কুল ছাড়িয়া পিতাকে ভেড়া চরানোর কাজে সহায়তা করিতে হইত।

 টমাস কার্লাইল নিজেও কৃষকের ছেলে ছিলেন, একথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। তাঁহার পিতা পুত্রকন্যাদের সঙ্গে একটি ক্ষুদ্র কৃষিক্ষেত্রে কাজ করিতেন এবং কোন প্রকারে জীবিকা নির্বাহ করিতেন। দরিদ্রের ঘরে জন্ম লাভ করিয়াও নিজের কৃতিত্ব বলে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি হইয়াছিলেন, এরূপ আরও কয়েকজন ব্যক্তির নাম পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে।

 আমেরিকা যুক্ত রাষ্ট্রে দরিদ্রের ঘরে জন্ম গ্রহণ করিলেও যে কোন ব্যক্তি প্রেসিডেণ্ট পদ লাভের আশা করিতে পারে। প্রেসিডেণ্ট উইলসন তাঁহার New Freedom নামক গ্রন্থে আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ত্ব কোথায় তাহা সুন্দর রূপে বর্ণনা করিয়াছেন:—

 “যখন আমি অতীত ইতিহাসের পাতা উল্টাই, আমেরিকা রাষ্ট্রের পত্তনের কথা ভাবি, তখন এই কথাটি আমেরিকার ইতিহাসের সর্বত্র লিখিত আছে দেখিতে পাই,—যে সমস্ত প্রতিভাশালী ব্যক্তি দরিদ্র অখ্যাত বংশ হইতে উদ্ভূত হন, তাঁহারাই জাতির জীবনে নূতন শক্তি ও উৎসাহের সঞ্চার করেন। ইতিহাস পড়িয়া যাহা কিছু জানিয়াছি, অভিজ্ঞতা ও ভূয়োদর্শনের ফলে যাহা কিছু জ্ঞান লাভ হইয়াছে, তাহাতে আমার এই প্রতীতি হইয়াছে যে, মানবের জ্ঞানসম্পদ সাধারণ মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার উপরেই প্রতিষ্ঠিত। ঐক্য, জীবনীশক্তি, সাফল্য উপর হইতে নীচে আসে না, বৃক্ষ যেমন গোড়া হইতে রস পাইয়া স্বাভাবিক ভাবে বাড়িয়া উঠে, পত্র পুষ্প ফলে ঐশ্বর্যশালী হয়, মানব সমাজেও ঠিক তেমনই ব্যাপার ঘটে। যে সমস্ত অজ্ঞাত অখ্যাত লোক সমাজের নিম্ন স্তরে তাহার মূল দেশে থাকিয়া জীবন সংগ্রাম করিতেছে, তাহাদেরই প্রচণ্ড শক্তির দ্বারা সমাজ উন্নত হইয়া


  1. David Lloyd George by J. N. Edwards.