ভারতের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ব্যবসা বাণিজ্যে অনিচ্ছা ও ঔদাসীন্য হেতু জাতীয় উন্নতির গতি রুদ্ধ হইয়া আসিয়াছে। দুই হাজার বৎসর পূর্বে ইশপ তাঁহার দূরদৃষ্টিবলে, এমন একটি সমাজশরীরের কল্পনা করিয়াছিলেন, যাহার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরস্পরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হইয়া উঠিয়াছে। হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরে আমরা সেই অসহযোগের দৃষ্টান্ত দেখিতেছি। বাংলাদেশের শতকরা ৫৫ ভাগ লোক, বংশ, জাতি ও ভাষায় এক হইয়াও, হিন্দু সমাজের আশ্রয় ত্যাগ করিয়া মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়াছেন। হিন্দু সমাজের ব্যবসায়ী জাতি— গন্ধবণিক, বর্ণবণিক, সাহা, তিলি—প্রভৃতিও হিন্দুধর্ম ত্যাগ করিত, যদি শ্রীচৈতন্যের অভ্যুদয় না হইত। শ্রীচৈতন্য সাম্য ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করিয়াছিলেন এবং জাতিভেদ উঠাইয়া দিবার জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই।
এই সব জাতি হিন্দুসমাজের অভ্যন্তরেই রহিল এবং বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করিল, যদিও সমাজের নিম্ন স্তরে ইহাদের স্থান হইল। এখন হিন্দু সমাজের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যায়। মুষ্টিমেয় লোক ইহার মস্তিষ্ক; কিন্তু বিশাল জনসমষ্টি যাহারা এই সমাজের দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তাহারা ঐ মস্তিষ্ক হইতে পৃথক এমন কি বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। এ যেন পুরাণ বর্ণিত কবন্ধবিশেষ!
এই ঘোর নির্বুদ্ধিতার জন্য বাংলা বিশেষ করিয়া ভীষণ ক্ষতি সহ্য করিয়াছে। বাংলার চিন্তাশীল শিক্ষিত সম্প্রদায়—যাহাদের মধ্যে দেশহিতৈষণা, রাজনৈতিক বোধ প্রভৃতি জাগ্রত হইয়াছে, তাহারা ধনী ও ঐশ্বর্যশালী ব্যবসায়ী সম্প্রদায় হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছে। যখন কোন জাতীয় কার্যে অর্থের জন্য আবেদন করা হয়, কেহই তাহাতে সাড়া দেয় না। অসংখ্য অস্পৃশ্য জাতি—নমঃশূদ্র, পোদ প্রভৃতির কথা দূরে থাকুক,—সাহা, তিলি, বণিকরা পর্যন্ত যেন সমাজদেহের অকর্মণ্য অঙ্গ হইয়া পড়িয়াছে, এবং বিদ্যুৎপ্রবাহ চালাইয়াও তাহাদের মধ্যে জীবনী শক্তি সঞ্চার করা যায় না।
আমি প্রকাশ্য বক্তৃতায় বহু বার হিন্দু সমাজের এই ‘অচলায়তনের’ কথা বলিয়াছি। সংবাদপত্রে কোন কোন পত্রলেখক আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিয়াছেন, তিলি, সাহা, সুবর্ণবণিক, সৎচাষী, এমন কি নমঃশূদ্রদের মধ্যেও নব্য বাংলার কোন কোন কৃতী সন্তান জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহারা তুলিয়াভুলিয়া যান যে, প্রকারান্তরে তাঁহারা আমার কথাই সমর্থন করিতেছেন। বাংলায় কয়েকটি তিলি বংশ আছেন, যাঁহারা কয়েক শতাব্দী ধরিয়া জমিদার ও ব্যবসায়ী, তাঁহাদের মধ্যে শিক্ষা ও সংস্কৃতি বরাবরই আছে। দীঘাপাতিয়া, কাশিমবাজার, ভাগ্যকুল, রাণাঘাট প্রভৃতি স্থানের তিলি বংশ হইতে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির উদ্ভব হইয়াছে,—তাঁহারা সর্বাংশেই উচ্চবর্ণীয়দের সমতুল্য। কৃষ্ণদাস পাল দরিদ্র তিলির গৃহে জন্ম গ্রহণ করিলেও সমাজে শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিলেন। সাহাগণও অনুরূপ গৌরবের দাবী করিতে পারে। জগন্নাথ কলেজ (ঢাকা), মুরারিচাঁদ কলেজ (শ্রীহট্ট), এবং রাজেন্দ্র কলেজ (ফরিদপুর), সাহাদের বদান্যতার ফলেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কলিকাতার কয়েকটি সুবর্ণবণিক পরিবার ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর বেনিয়ান রূপে ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্য হইতেও উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের উদ্ভব হইয়াছে।
কিন্তু বাংলাদেশের আদমসুমারীর বিবরণ পড়িলে, আমার কথার যাথার্থ্য প্রমাণিত হইবে। পূর্বে যে সব দৃষ্টান্ত উল্লিখিত হইল, সেগুলি ব্যতিক্রম মাত্র। জাতিভেদ প্রথার ঘোর অনিষ্টকারিতা হিন্দু ভারতের সর্বত্রই জাজ্জ্বল্যমান।[১]
- ↑ “তৃতীয় শতাব্দীতে এই সংকীর্ণতার অনিষ্টকর ফল দেখা গিয়াছিল। রোমক সমাজ অবসাদে ক্ষয় হইতে লাগিল, একটা গুপ্ত কারণ উহার জীবনী শক্তি নষ্ট করিতে লাগিল। যখন একটা