পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৮৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫০
আত্মচরিত

গাঁজা দেওয়া হইলে সাধু কিঞ্চিৎ শান্ত হইলেন। তারপর আটা, ঘি, প্রভৃতি বহুবিধ খাদ্যদ্রব্যের তালিকা হইল। এই সব খাদ্যে সাধু ও তাঁহার নিষ্কর্মা চেলাদের উদর পূজা হইবে। এক কথায় ব্যবসায়ীটি কোন দ্বিধা না করিয়া সাধু ও তাঁহার চেলাদের জন্য তখনই পাঁচ শত টাকা খরচ করিয়া ফেলিলেন, কেন না তাঁহার মতে উহা পুণ্য কার্য। কিন্তু তিনিই আবার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য পাঁচটি টাকা দিতে অসম্মত হইলেন, যদিও ঐ বিদ্যালয়ের দ্বারা তাঁহার স্বজাতীয় ছেলেরাই অধিকতর উপকৃত হইবে।[]

 আমি আর একটি দৃষ্টান্ত দিব। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইসচ্যান্‌সেলার নূতন গৃহের জন্য অতি কষ্টে সাধারণের চাঁদা হইতে আট হাজার টাকা সংগ্রহ করিয়াছেন। আর তাহারই দুই এক মাইলের মধ্যে একজন মাড়োয়ারী ব্যবসায়ী জয়পুর হইতে আনীত শ্বেত ‘মাক্রানা’ প্রস্তরের একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছেন! এই বহুমূল্য প্রস্তর দিয়াই কলিকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মিত হইয়াছে।[] ঐ মন্দিরে মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীর প্রায় ছয় লক্ষ টাকা ব্যয় হইয়াছে। ইহার উপর মন্দির সংলগ্ন একটি ধর্মশালার জন্যও তিনি অনেক টাকা ব্যয় করিয়াছেন। আর একজন ধনী মাড়োয়ারী, হিন্দুদের প্রসিদ্ধ তীর্থ পুষ্কর ক্ষেত্রে ১২ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছেন!

 এই সব মন্দির ও ধর্মশালায় সেকেলে গোঁড়া পুরোহিত এবং গাঁজাখোর সাধুদেরই আড্ডা। সুতরাং এই সব দান হইতে সমাজের খুব কমই উপকার হয়। কিন্তু এ বিষয়ে কেবল মাড়োয়ারীদের দায়ী করিয়া কি হইবে? কচ্ছী মেমন এবং নাখোদা মুসলমানেরা কলিকাতার ধনী ব্যবসায়ী, কিন্তু তাহাদের কোন শিক্ষা ও সংস্কৃতি নাই এবং তাহাদের দৃষ্টি মাড়োয়ারীদের মতই সঙ্কীর্ণ, তাহারা মসজিদ নির্মাণ ও সংস্কার করিতে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করিবে, কিন্তু বিদ্যালয় বা হাঁসপাতাল নির্মাণের জন্য এক পয়সাও দিবে না। হালের একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি:—

 “কচ্ছী মেমন বা নাখোদা মুসলমানদের বদান্যতায় জাকেরিয়া স্ট্রীটে—বাংলার মধ্যে বৃহত্তম মসজিদ নির্মিত হইতেছে। ইহার জন্য ব্যয় পড়িবে প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা। ভারতে এরূপ মসজিদ আর নাই। ইমারতটি চারতলা হইবে এবং স্থাপত্য শিল্প ও সৌন্দর্যের অত্যুৎকৃষ্ট নিদর্শন হইবে। প্রধান গম্বুজের উচ্চতা হইবে ১১৬ ফিট, দুইটি প্রধান মিনার ১৫১ ফিট করিয়া উচ্চ হইবে এবং তাহার নীচে ২৫টি ছোট ছোট মিনার থাকিবে। এম. এস. কুমার মসজিদটির নক্সা প্রস্তুত করিয়াছেন এবং তাঁহারই তদারকীতে উহা নির্মিত হইতেছে।”—The Illustrated Weekly Hindu (27th July, 1980).

 এবিষয়ে মাদ্রাজ সৌভাগ্যশালী, চেটিদের মধ্যে অনেকেই ধনী মহাজন ও ব্যাঙ্কার। তাহারা মাদ্রাজ প্রদেশেরই লোক। তাহারা যে অর্থ উপার্জন করে, তাহা মাদ্রাজেই থাকে।


  1. এই অংশের প্রুফ দেখিবার সময়, আমি জানিতে পারিলাম যে, একজন তিলি ব্যবসায়ী মহাসমারোহে তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহ দিয়াছেন। তিনি একখানি বিমান যান ভাড়া করিয়া কন্যার বাড়ীতে উপহার দ্রব্য পাঠাইয়াছেন, দুইখানি প্রথম শ্রেণীর গাড়ী যুক্ত স্পেশ্যাল ট্রেনে বরযাত্রীদিগকে লইয়া গিয়াছেন। এইরূপে বাহ্য আড়ম্বরের জন্য তিনি হাজার হাজার টাকা ব্যয় করিতেছেন। কিন্তু এই ব্যক্তিই হয়ত তাঁহার স্বজাতীয় বালিকাদের শিক্ষার জন্য প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করিতে অল্প কয়েক শত টাকাও দিতে চাহিবেন না। খুব সম্ভব যে অর্থ এখন তিনি অপব্যয় করিতেছেন, তাহা তাঁহার পিতা মাথায় পণ্যের বোঝা বহিয়া অতি কষ্টে উপার্জন করিয়াছিল। সে তাহার জীবিতকালে মোটর গাড়ীতেও চড়ে নাই, আর তাহার ছেলে—ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহে বিমানযান ভাড়া করিয়া উপহারদ্রব্য পাঠাইতেছে!
  2. মধ্যপ্রদেশে বাংলার চেয়েও মাড়োয়ারীদের বেশী প্রাধান্য। রাইপুর, বিলাশপুর, ছত্রিশগড় প্রভৃতি স্থান মাড়োয়ারীদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হইয়া উঠিয়াছে।