পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
৩৫১

দুর্ভাগ্যক্রমে তাহাদের দৃষ্টান্ত সঙ্কীর্ণ ও অনুদার। একজন অন্নমালী চেটিয়ার (বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম বলিলেও হয়। এই সব চেটিয়া মন্দির সংস্কার এবং বিগ্রহের অলঙ্কারে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে।[]

 গঙ্গাসাগর স্নানের সময় (মকর সংক্রান্তিতে সহস্র সহস্র যাত্রী পুণ্য লাভার্থে ব্যয় এবং ধনী মাড়োয়ারীরা বাবাজী ও ভিক্ষুকদের যাতায়াতের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে। তাহারা মনে করে উহাতে তাহাদের পুণ্য হইবে। আজিমগঞ্জ (মুর্শিদাবাদ) ও অন্যান্য স্থানে বহু ধনী জৈন আছেন; তাঁহারা ঐ সব স্থানে প্রায় তিন শত বৎসর হইল বাস করিতেছেন। তাঁহারা আবু পর্বত এবং পলিতানায় (গুজরাট) প্রতি বৎসর তীর্থ দর্শনে যান। তাঁহারা এই উপলক্ষ্যে এক এক জন ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ব্যয় করিয়া থাকেন। মধ্যযুগে ইয়োরোপীয় খৃষ্টানদের মনে জেরুজেলাম তীর্থে ক্রুজেড সম্বন্ধে যেরূপ মনোভাব ছিল, এই জৈনদের মনোভাবও অনেকটা সেইরূপ। যে কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিলাম, তাহা ব্যতিক্রম নহে, সাধারণ নিয়ম এবং উহা হইতেই ব্যাপার কিরূপে দাঁড়াইয়াছে বুঝা যাইতে পারে।

 শুধু, মাড়োয়ারী বা জৈনদের দোষ দিলেই বা কি হইবে, যাঁহারা চিন্তানায়ক হইবার দাবী করেন, এখন সব কলেজে শিক্ষিত বাঙালীরাও, পৌরোহিত্যের কুসংস্কার আঁকড়াইয়া ধরিয়া আছেন এবং নানা অসম্ভব গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতা পোষণ করেন। তাঁহারাও সাধারণ লোকদের মতই সাধুদের মোহে প্রলুব্ধ ও প্রতারিত হন। মুন্সীগঞ্জের সত্যাগ্রহই তাহার দৃষ্টান্ত। সেখানকার উকীলেরা (কেহ কেহ তন্মধ্যে এম. এ. বি. এল.) নিম্নজাতীয়দিগকে মন্দিরে প্রবেশ করিতে দিতেছেন না।[]


  1. “এসব ব্যাপারে কিরূপ প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়, তাহার আর একটি দৃষ্টান্ত আমি দিতেছি। ৯ বৎসর পূর্বে আমি যখন পুনর্বার রামনাদে যাই, তখন দেখি সেখানে ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি মন্দিরের সংস্কার হইতেছে।”—J. B. Pennington: India, Jan 13, 1919.
  2. ‘সভ্যতার ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক স্পেনের অধঃপতন সম্বন্ধে মর্মস্পর্শী ভাষায় নিম্নলিখিতরূপ বর্ণনা করিয়াছেন:—
     “যে জাতি সতৃষ্ণ নয়নে কেবল অতীতের দিকে চাহিয়া থাকে, সে কখনও উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারে না। উন্নতি যে সম্ভবপর, ইহাই তাহারা বিশ্বাস করে না। তাহাদের নিকট প্রাচীনতাই জ্ঞানের প্রতীক এবং প্রত্যেক উন্নতিচেষ্টাই বিপজ্জনক। স্পেন ঠিক এই অবস্থায় আছে। এই কারণে স্পানিয়ার্ডদের মধ্যে এমন অচলতা ও জড়তা, তাহাদের মধ্যে জীবনের চাঞ্চল্য নাই, আশা উৎসাহ নাই। এই কর্মবহুল যুগে তাহারা সভ্য জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া আছে। বিশেষ কিছু করা সম্ভব নয়, এই বিশ্বাসে তাহারা কিছুই করিতে চায় না। তাহারা বিশ্বাস করে যে, প্রাচীনকাল হইতে যে জ্ঞান তাহারা পরম্পরাক্রমে লাভ করিয়াছে, বর্তমান যুগে তার চেয়ে বেশী জ্ঞান লাভ করা যায় না। এই কারণে তাহারা তাহাদের সঞ্চিত জ্ঞান ভাণ্ডার রক্ষা করিবার জন্যই ব্যস্ত, নূতন কোন পরিবর্তনের কল্পনা তাহারা সহ্য করিতে পারে না, যদি তাহার ফলে প্রাচীন জ্ঞানের মূল্য কমিয়া যায়!... এদিকে মানুষের জ্ঞান জগতে যুগান্তর সৃষ্টি হইতেছে, মনুষ্য প্রতিভা অভূতপূর্ব উন্নতি করিতেছে। স্পেন নিশ্চিন্তভাবে ঘুমাইতেছে, বহির্জগতের কোন আঘাতে সে সাড়া দেয় না, নিজেও বহির্জগতে কোন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে না। ইয়োরোপীয় মহাদেশের এক কোণে মধ্য যুগের ভাব প্রবাহ ও সঞ্চিত জ্ঞানের ধ্বংসাবশেষ স্বরূপ এই বিশাল দেশ নিশ্চেষ্টব‍ৎ পড়িয়া রহিয়াছে। এবং সকলের চেয়ে দুর্লক্ষণ স্পেন তাহার এই শোচনীয় অবস্থাতেই সুখী। যদিও ইয়োরোপের মধ্যে সে সর্বাপেক্ষা অনুন্নত দেশ, তবু সে নিজেকে সর্বাপেক্ষা উন্নত মনে করে। যে সব জিনিষের জন্য তাহার লজ্জিত হওয়া উচিত, সেই সব জিনিষের জন্যই সে গর্বিত।”
     এই সব মন্তব্য ভারতের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে অধিকতর প্রযোজ্য। স্পেনে অন্ততঃপক্ষে জাতিভেদ ও অস্পৃশ্যতা নাই অথবা স্পানিয়ার্ড এবং ইংরাজ, ফরাসী বা অন্য কোন জাতীয় লোকের সঙ্গে বিবাহের বাধাও নাই।