আধুনিক অর্থনীতি শাস্ত্রেও তাঁহার গভীর পাণ্ডিত্য। মাড়োয়ারীদের সঙ্গে তুলনার গুজরাটীরা অধিকতর উদার দৃষ্টি সম্পন্ন এবং দেশানুরাগী। লোকহিতের জন্য নিজের স্বার্থবুদ্ধি কিরূপে সংযত করিতে হয়, মাড়োয়ারীদের সে বিষয়ে এখনও অনেক শিখিবার আছে। সে কেবল স্বার্থের প্রেরণায় অর্থোপার্জন করে। গুজরাটে একটি প্রচলিত কথা আছে—“তমে মাড়োয়ারী থেই গেয়া”—(তুমি মাড়োয়ারী হইয়াছ)। ইহা তিরস্কার বাক্য রূপে ব্যবহৃত হয়।
বাংলার আর একটি দুর্ভাগ্যের কথা বলিব যে সমস্ত মাড়োয়ারী ও ভাটিয়া এ দেশে কয়েক পুরুষ ধরিয়া বাস করিতেছে, তাহারাও বাংলাকে নিজেদের দেশ বলিয়া মনে করে না। তাহারা বাঙালীর ব্যবসা বাণিজ্য দখল করিয়া প্রভূত ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিতেছে। কিন্তু এই ঐশ্বর্য হইতে, তাহাদের বাসভূমি বাংলার কোন উপকার হয় না। কলিকাতার অধিকাংশ ধনী ব্যবসায়ী বিকানীরের লোক এবং তাহারা বিকানীরেই নিজেদের ঐশ্বর্য লইয়া যায়। ব্রিটিশেরা যতদিন বাংলায় থাকে, ততদিন খানসামা, বাবুর্চী, আয়া প্রভৃতির বেতন বাবদ এবং মুরগী, ডিম, মাছ প্রভৃতি কিনিয়া কিছু টাকা বাংলায় দেয়। কিন্তু মাড়োয়ারী এ দিক দিয়াও বাংলাকে এক পয়সা দেয় না। সে তাহার নিজের খাদ্য দ্রব্য আটা, ডাল, ঘি প্রভৃতি নিজের দেশ হইতে লইয়া আসে। তাহার ভৃত্যরাও হিন্দুস্থানী এবং নিরামিষভোজী বলিয়া তাহারা মুরগী, ডিম, মাছ প্রভৃতিও কিনে না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দাতাদের দানের পরিমাণ প্রায় ৬৬ লক্ষ টাকা, কিন্তু কোন মাড়োয়ারী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু দান করে নাই। নাগপুরের যে ধনী ব্যবসায়ীর কথা পূর্বে বলিয়াছি, মাড়োয়ারী ধনীদের মনোবৃত্তি অনেকটা সেইরূপ।[১]
মাড়োয়ারীরা বাংলাদেশের অথবা মধ্য প্রদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য উদার ভাবে দান করিতে কুণ্ঠিত। যে দেশে সে ঐশ্বর্য সঞ্চয় করে, সে দেশ তাহার নিকট হইতে কোন উপকার পায় না। কিন্তু আর একজন শিক্ষিত ও ধনী হিন্দুর নাম আমি উল্লেখ করিব। যে দেশে তিনি অর্থোপার্জন করিয়াছেন, সেই দেশের প্রতি তাঁহার কৃতজ্ঞতার ঋণ স্মরণ করিয়া, তিনি উহার প্রতিদানে প্রায় সমস্ত সম্পত্তি দিয়াছেন। ইনি রাও বাহাদুর লক্ষ্মীনারায়ণ, কাম্তীর ব্যবসায়ী। সম্প্রতি (নভেম্বর, ১৯৩০) নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পশিক্ষার ব্যবস্থার জন্য তিনি ৩০ লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।
কলিকাতার ধনী মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের নিকট আমি ক্ষমা লাভের প্রত্যাশী। মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের বিরদ্ধে মাড়োয়ারী বলিয়াই আমার কোন অভিযোগ নাই। তাহারা মোটেই
- ↑ বিশ্ববিদ্যালয়ে মাড়োয়ারীদের দান যে অতি সামান্য তাহা নিম্নলিখিত তালিকা হইতে বুঝা যাইবে:—
“কেশোরাম পোদ্দার (আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মেডাল ফাণ্ড) ১০,০০০৲; বিড়লা হিন্দী লেকচারশিপ ফণ্ড ২৬,২০০৲; গণপতি রাও খেমকা (পঞ্চম জর্জ করোনেশান মেডাল ফণ্ড) ১,০০০৲; মোট ৩৭,২০০৲।
বোম্বাইয়ের অধিবাসীদের মত মাড়োয়ারীদের যদি দেশহিতৈষণার ভাব থাকিত তবে তাহারা স্থানীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে, যথা—বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ, চিত্তরঞ্জন জাতীয় আয়ুর্বিজ্ঞান পরিষৎ, মূক বধির বিদ্যালয়, অন্ধ বিদ্যালয় প্রভৃতিতে কয়েক কোটি টাকা দান করিত। “যাহার প্রচুর আছে, তাহার নিকটেই লোক বেশী প্রত্যাশা করে।”
পক্ষান্তরে, অ্যান্ড্রু কার্নেগী তাঁহার বাসভূমির হিতসাধনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন। “পিট্সবার্গে আমি ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছি। আমি পিট্সবার্গ সহরে জনহিতকর কার্যে ২ কোটী ৪০ লক্ষ পাউণ্ড দিয়াছি বটে, কিন্তু পিট্সবার্গ হইতে আমি যাহা পাইয়াছি, উহা তাহার কিয়দংশ মাত্র। পিট্সবার্গ ইহা পাইবার অধিকার রাখে।”—আত্মচরিত।