পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ
৩৫৫

বিড়লা ভ্রাতারা বাংলা দেশে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করিয়া থাকেন, কিন্তু বাংলায় বাস তাঁহাদের নিকট প্রবাস মাত্র।

 স্মরণ রাখিতে হইবে, শিক্ষা সংস্কৃতি এবং উদার দৃষ্টির দিক দিয়া, বিড়লারা উচ্চশ্রেণীর মাড়োয়ারী। কিন্তু তবু, তাঁহারা তাঁহাদের জাতিগত সঙ্কীর্ণতা এবং গ্রাম্য অনুদার ভাব ত্যাগ করিতে পারেন না।

(৪) হিন্দু রক্ষণশীলতার পুনরভ্যুদয় ভারতের

উন্নতির পক্ষে বাধা স্বরূপ

 আমাদের বহু হিন্দু পুনরুত্থানবাদীরা গীতায় উচ্চাঙ্গের অধ্যাত্মতত্ত্ব সম্বন্ধে বক্তৃতা করিবেন, হিন্দু ধর্মের সার্বভৌমিক উদারতা এবং অন্য ধর্মের চেয়ে তাহার শ্রেষ্ঠতার ব্যাখ্যা করিবেন, অস্পৃশ্যতার তীব্র নিন্দা করিবেন। কিন্তু যখন এই সব তত্ত্ব ও উপদেশ কার্যে পরিণত করিবার সময় উপস্থিত হয়, তখন তাঁহারাই সর্বাগ্রে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেন। অধ্যাপক ওয়াদিয়া বলিয়াছেন:—

 “আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা হিন্দুধর্মের উদারতা সম্বন্ধে অজস্র শ্লোক উদ্ধৃত করেন, কিন্তু যদি কেহ সেগুলি আন্তরিক বলিয়া গ্রহণ করেন, তবে তিনি একান্তই নিরাশ হইবেন। উদ্ধৃত শ্লোকগুলি কেবল লোকদেখানোর জন্য, কাজ করিবার জন্য নহে। আমার মনে হয় যে, হিন্দুধর্মকে উদার ও সার্বভৌম প্রমাণ করিবার জন্য এত বেশী সময় ব্যয় করা হইয়াছে যে, তদনুসারে কাজ করিবার সময় পাওয়া যায় নাই! ভয় হইতেই নির্যাতন আসে; এই ভয়কে জয় না করিলে, কেহই পূর্ণ মনুষ্যত্ব লাভ করিতে পারে না।”—দার্শনিক সম্মেলনে সভাপতির বক্তৃতা (ডিসেম্বর, ১৯৩০)।

 সুতরাং, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে যে, হিন্দুসভা এবং সংগঠনের ঝুড়ি ঝুড়ি বক্তৃতা সত্ত্বেও, প্রত্যহই বহু হিন্দু মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিতেছে। কেনই বা করিবে না? সামাজিক ব্যাপারে, ইসলাম জাতি, বর্ণ অথবা মতামতের পার্থক্য স্বীকার করে না। অস্পৃশ্যতা ইসলাম ধর্মে অজ্ঞাত। কার্লাইলের মতে, ইহা মানুষের মধ্যে সাম্যবাদের প্রচার করে। কার্লাইল অন্যত্র বলিয়াছেন,—“যে মানুষের কথা শুনিয়া বুঝা যায় না, সে কি করিবে বা কি করিতে চায়, তাহার সঙ্গে কোন কাজ করা অসম্ভব। সেই মানুষকে তুমি বর্জন করিবে, তাহার সংস্পর্শ হইতে দূরে থাকিবে।” আশ্চর্যের বিষয় নহে যে, নমঃশূদ্র বন্ধুরা হিন্দু নেতাদের ভণ্ডামীতে বিরক্ত হইয়া অন্য ধর্মের আশ্রয় গ্রহণ করিতে উদ্যত হইবে।[]


  1. ১৭-৬-৩১ তারিখের দৈনিক সংবাদপত্রসমূহে “উচ্চবর্ণীর হিন্দুদের অত্যাচার” শীর্ষক নিম্নলিখিত সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল:—  “ঢাকায় সংবাদ আসিয়াছে যে, শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জ মহকুমার সমগ্র নমঃশূদ্র সম্প্রদায় মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিতে উদ্যত হইয়াছে। নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের ডাঃ মোহিনীমোহন দাস সুনামগঞ্জ বার লাইব্রেরী এবং কংগ্রেস কমিটীর নিকট এ বিষয়ে সত্য সংবাদ জানিবার জন্য তার করেন। তিনি উত্তর পাইয়াছেন যে, ঘটনা সত্য। উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের অত্যাচার এবং ঢাকার একজন মুসলমান মৌলভীর প্রচারকার্যের ফলেই এরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছে।”
     যে খৃষ্টান ধর্ম ভগবানের পিতৃত্ব এবং মানবের ভ্রাতৃত্ববোধের উপর প্রতিষ্ঠিত বলিয়া দাবী করে, মুসলমান ধর্ম স্থানে স্থানে তাহাকেও অতিক্রম করিতেছে। ইসলাম ধর্মের দৃষ্টি উদার গণতন্ত্রমূলক। জনৈক আধুনিক লেখক বলিয়াছেন—“ইসলাম ধর্ম মরুভূমির মধ্যে জন্ম লাভ করিরাছিল। মরুভূমি সাম্যবাদের প্রধান ক্ষেত্র। ইসলাম ধর্ম অতি শীঘ্রই তিন মহাদেশে বিস্তৃত