পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
প্রথম পরিচ্ছেদ

একদিন পাশা খেলিতেছিলেন, এমন সময় তিনি একখানি পত্র পাইলেন; তিনি ক্ষণকালের জন্য পাশা খেলা হইতে বিরত হইলেন, পত্রখানি আগাগোড়া পড়িলেন, তারপর একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। কিন্তু তাঁহার মখভাবের কোন পরিবর্তন হইল না, পূর্ববৎ পাশা খেলায় প্রবৃত্ত হইলেন। বোধ হয়, যে ব্যাঙ্কে তিনি টাকা গচ্ছিত রাখিয়াছিলেন, সেই ব্যাঙ্ক ফেল পড়িয়াছিল।[১] কিন্তু প্রপিতামহ চতুর লোক ছিলেন। সুতরাং, তিনি নিশ্চয়ই তাঁহার সমস্ত ধন একস্থানে গচ্ছিত রাখেন নাই। সম্ভবতঃ তিনি প্রাচীন প্রথামত তাঁহার অর্থ মাটীর নীচে পুঁতিয়া রাখিয়াছিলেন, অথবা ঘরের মেজেতে বা দেয়ালে সংরক্ষিত করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ আমার বাল্যকালে ঘরের দেয়ালে এইরূপ একটি শূন্য গুহা আমি দেখিয়াছি।[২] আমাদের বংশে প্রবাদ আছে যে, আমার পিতামহ প্রপিতামহের সঞ্চিত ধনের গুপ্ত সংবাদ জানিতেন। কিন্তু তাঁহার অকস্মাৎ মৃত্যু হওয়াতে পিতাকে কিছুই বলিয়া যাইতে পারেন নাই। একথা পূর্বে বলিয়াছি।

 আমাদের বাড়ীর অন্দর মহলের উপরতলার (যাহা এখনও আছে) দরজা লোহার পাত দিয়া মোড়া, তাহার উপর বোল্ট্ বসানো। ইহার উদ্দেশ্য, ডাকাতেরা সহজে যাহাতে ঐ দরজা না ভাঙ্গিতে পারে। এই উপরতলার কিয়দংশ এখনও “মালখানা” নামে অভিহিত হয়। আমার পিতা দেয়ালের স্থানে স্থানে গুপ্তধনের সন্ধানে খুঁড়িয়াছিলেন। কিন্তু কিছুই পান নাই, ঐ সমস্ত স্থান এখনও দেখা যায়, কেননা সেখানে নঁতন ইট সুরকী বসাইয়া মেরামত করা হইয়াছিল। বহু বৎসর পরে আমার পিতার যখন অর্থসঙ্কট উপস্থিত হয় এবং পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রয় হইতে থাকে, তখন আমার মাতা (যদিও সাধারণতঃ তিনি কুসংস্কারগ্রস্ত ছিলেন না) একজন গুণীকে ডাকিয়া পাঠান এবং তাঁহার নির্দেশ অনুসারে সিঁড়ির নীচে একটি স্থান খনন করান, কিন্তু এ চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। আমি এই ব্যাপারে বেশ কৌতুক অনুভব করি। কেননা, আমার ঐ সব অতি-প্রাকৃত ব্যাপারে কখনই বিশ্বাস ছিল না।

আমার পিতা

 প্রায় ২৫ বৎসর বয়সে আমার পিতা পৈতৃক সম্পত্তি দেখাশুনা করার ভার গ্রহণ করেন। তিনি খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি পারসী ভাষা জানিতেন, সংস্কৃত ও আরবীও কিছু জানিতেন।


  1. এই ব্যাঙ্কের নাম পামার এণ্ড কোং, এরূপ মনে করিবার কারণ আছে। ১৮২৯ সালে ঐ ব্যাঙ্ক ফেল পড়াতে বহু ইউরোপীয় ও ভারতীয় সর্বস্বান্ত হন।
  2. সপ্তদশ শতাব্দীর শেষে ইংলণ্ডেও টাকাকড়ি গচ্ছিত রাখা কষ্টকর ছিল, সুতরাং লোকে সাধারণতঃ অর্ধ মাটির নীচে বা ঘরের মেজেতে লুকাইয়া রাখিত। কথিত আছে যে, কবি পোপের পিতা তাঁহার প্রায় একশত বিশহাজার পাউণ্ড নিজের বাড়ীতে এই ভাবে লুকাইয়া রাখেন।...তৃতীয় উইলিয়মের শাসনের প্রথম ভাগে ইংলণ্ডের অধিকাংশ লোকই স্বর্ণ ও রৌপ্য গোপনীয় সিন্দুকে প্রভৃতিতে লুকাইয়া রাখিত।—মেকলে, ইংলণ্ডের ইতিহাস।
     বাঙ্গলা, বিহার এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশের যে সব অংশে পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রবেশ করে নাই, সেখানকার লোকেরা এখনও অর্থ ঐ ভাবে লুক্কায়িত রাখে।
     সুসভ্য ফ্রান্সে কৃষকেরা এখনও উলের মোজাতে করিয়া ঘরের মেঝেতে অথবা মাটীর নীচে অর্থ সঞ্চিত করে (‘ডেলী হেরাল্ড’ হইতে কলিকাতার সংবাদ পত্রে উদ্ধৃত বিবরণ—ফেব্রুয়ারী, ২৯শে, ১৯৩২)।
     যদিও বর্তমানে অনেক গ্রামে ডাকঘরের সেভিংস ব্যাঙ্ক এবং কো-অপারেটিভ ক্রেডিট সোসাইটীর ব্যাঙ্কের সুবিধা আছে, তথাপি প্রাচীন রীতি অনুযায়ী অর্থ সঞ্চয়ের প্রথা এখনও বিদ্যমান।
     ডাঃ এইচ, সিংহের ‘Early European Banking in India', পৃঃ ২৪০ দ্রষ্টব্য।