পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৩৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৫৮
আত্মচরিত

 সুপ্রজনন বিদ্যা সম্বন্ধে আমার এত কথা বলিবার কারণ এই যে, আমি আমার নিজের রুচি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে কয়েকটি কথা এই প্রসঙ্গে বলিতে চাই। আমার চরিত্রের কোন কোন বৈশিষ্ট্য পৈতৃক ধারা হইতে প্রাপ্ত মনে করা যাইতে পারে। কিন্তু আমার বাল্যকালেই আমি যে ব্যবসা বুদ্ধি লাভ করিয়াছিলাম, তাহার কোন বংশানুক্রমিক ব্যাখ্যা করা যায় না। আমি পূর্বেই বলিয়াছি কৃষিকার্যের প্রতি আমার প্রবল অনুরাগ ছিল। আমি কোদাল দিয়া মাটী কাটিতাম, এবং নিজে চাষ করিয়া বীজ বুনিয়া নানারূপ ফসল উৎপাদন করিতাম। গোবর, ছাই এবং গলিত পত্রের সার দিয়া জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি করিতাম। কৃষকেরা যে প্রণালীতে চাষ করিত, তাহা আমি মনোযোগ সহকারে লক্ষ্য করিতাম। আমি দেখিতাম, যে পোড়া পাতার ছাই ব্যবহারে জমির উর্বরতা বাড়ে এবং ঐ জমিতে কচু ও কলা প্রভৃতি ভাল হয়। অবশ্য, আমি তখন জানিতাম না যে,—গাছের পাতার ছাইয়ে যথেষ্ট পরিমাণে পটাশ আছে। অন্য নানা রকম ফসলও আমি জন্মাইতাম। আমি এই সব কাজ ইচ্ছা মত করিতে পারিতাম, কেননা আমার পিতামাতা এ বিষয়ে আমাকে উৎসাহ দিতেন এবং এই উদ্দেশ্যে মজুর প্রভৃতি কাজে লাগাইবার জন্য অর্থও দিতেন। অর্দ্ধ শতাব্দী পূর্বে আমি যে নারিকেল ও সুপারির গাছ রোপণ করিয়াছিলাম, তাহা এখনও বাল্যের মধুর স্মৃতি জাগরুক করে। কলিকাতায় আসিবার পর হইতে আমি গ্রীষ্মের ছুটী ও শীতের ছুটীর প্রতীক্ষা করিয়া থাকিতাম,—ঐ সময়ে বাড়ী গিয়া মনের সাধে চাষের কাজ করিতে পারিব, ইহাই ভাবিতাম। আমার স্বভাবগত ব্যবসাবুদ্ধিও এই সময়ে প্রকাশ পাইত। আমাদের জমিতে যে ফসল হইত তাহার সামান্য অংশই পরিবারের প্রয়োজনে লাগিত। উদ্বৃত্ত ফসল হাটে বাজারে বিক্রয় করিতে হইত। ইহাতে চাষের খরচা উঠিয়া লাভের সম্ভাবনা থাকিত।

 এই সময় হইতে আমার দোকানদারী বুদ্ধি বা ব্যবসাবুদ্ধির[] বিকাশ হইল। গ্রামের জমীদারের ছেলে হইয়া জমির ফসল হাটে বাজারে বিক্রয় করি, ইহাতে আমাদের কোন কোন প্রতিবেশী লজ্জা বোধ করিতেন। কিন্তু আমি উহা গ্রাহ্য করিতাম না। কয়েক বৎসর পরে আমার এই ব্যবসাবুদ্ধি বিপদে আমার সহায় স্বরূপ হইল। আমার পিতা ভাবপ্রবণ লোক ছিলেন, এক সময়ে তিনি ঝোঁকের মাথায় একটি কাজ করিয়া লোকসান দিয়াছিলেন। এইচ. এইচ. উইলসনের সংস্কৃত-ইংরাজী অভিধান ঐ সময়ে দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছিল। ৪০।৫০ টাকাতেও উহার এক খণ্ড পাওয়া যাইত না। একজন পণ্ডিত ব্যক্তি আমার পিতাকে ঐ গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ করিতে সম্মত করেন। পণ্ডিত নিজে পুস্তকের মুদ্রণ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধান করিবার ভার লইলেন এবং পিতাকে বুঝাইলেন বই বিক্রী করিয়া খুব লাভ হইবে। বই ছাপা হইল। কিন্তু আশানুরূপ বিক্রয় হইল না এবং আমার পিতার প্রায় সাত হাজার টাকা লোকসান হইল। তখনকার দুইজন সপরিচিত সংস্কৃত গ্রন্থ প্রকাশক পণ্ডিত জীবানন্দ বিদ্যাসাগর এবং ভুবনমোহন বসাক প্রতি কপি নাম মাত্র দুই টাকা মূল্যে কয়েক শত বই কিনিলেন। তাঁহারা ব্যবসায়ী লোক ছিলেন, সুতরাং বই বিক্রয় করিয়া তাঁহাদের বেশ লাভ হইল। কিন্তু অবশিষ্ট কয়েক শত খণ্ড বই আমাদের বাড়ীতেই রহিল। আমি পুরানো কাগজের দরে উহা বিক্রী করিতে রাজী হইলাম না। আমি সযত্নে সেগুলি বাঁধাই করিয়া রাখিলাম। বাংলার আর্দ্র জল বায়ুতে উই ও কীটের হাত হইতে এই সমস্ত বই রক্ষা করা দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু আমার যত্ন ও


  1. আমি ব্যাপক ভাবে এই শব্দ ব্যবহার করিতেছি। নেপোলিয়ান ইংরেজ জাতিকে অবজ্ঞাভরে বলিতেন—“দোকানদারের জাতি”।