ঊনত্রিংশ পরিচ্ছেদ
পরিশিষ্ট (১)
যে সব মানুষকে আমি দেখিয়াছি
যদিও রাজনীতিক হইবার দুরাকাঙ্ক্ষা আমার কোন কালেই ছিল না, বক্তা হিসাবে প্রসিদ্ধ হইবার ইচ্ছাও আমার নাই,—তথাপি খ্যাতনামা রাজনৈতিক বক্তাদের বক্তৃতা শুনিবার সুযোগ আমি কখনও ত্যাগ করি নাই। ইলবার্ট বিল আন্দোলন যখন প্রবল ভাবে চলিতেছিল, তখন (১৮৮৩) উইলিসের কক্ষে লর্ড রিপনকে সমর্থন করিবার জন্য লিবারেল রাজনীতিকদের এক সভা হয়, আমি ঐ সভাতে যোগ দেই। জন ব্রাইট সভাপতির আসন গ্রহণ করেন,—বক্তৃাদের মধ্যে ডবলিউ. ই. ফরষ্টার, স্যার জর্জ কাম্বেল এবং লালমোহন ঘোষ ছিলেন। আমাদের স্বদেশবাসী লালমোহনের বক্তৃতা চমৎকার হইয়াছিল, যদিও তাঁহার পূর্বে ইংলণ্ডের তদানীন্তন শ্রেষ্ঠ বক্তা ব্রাইট বক্তৃতা করেন। গ্ল্যাডষ্টোন, জোসেফ চেম্বারলেন, মাইকেল ডেভিট্, জন ডিলন, উইলফ্রিড লসন, লর্ড রোজবেরী, এবং এ. জে. ব্যালফুরের বক্তৃতা আমি শুনিয়াছি। আমি এডিনবার্গের একটি প্রসিদ্ধ জনসভাতেও উপস্থিত ছিলাম, ঐ সভায় প্রসিদ্ধ আফ্রিকা ভ্রমণকারী এইচ. এম. ষ্ট্যান্লি প্রধান বক্তা ছিলেন। ১৯২৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিরূপে আমি যখন ডাবলিনে যাই, তখন অতিথিদের সম্বর্ধনার জন্য একটি উদ্যান সম্মিলনী হয়। আমি সেখানে আইরিশ ফ্রি ষ্টেটের গবর্ণর জেনারেল মাননীয় টি. এম. হিলির সাক্ষাৎ লাভ করি। তিনি তখন বয়সে প্রবীণ এবং তাঁহার যৌবনের তেজস্বিতা কিছু শান্ত হইয়াছে। তাঁহার সহাস্য বদন এবং মধুর ব্যবহার দেখিয়া মনে হয় নাই যে, তিনিই পূর্বকালের সেই বিখ্যাত “টিম” হিলি; গত ১৮৮০ সালের কোঠায় ইনিই পার্লামেণ্টে চরম পন্থী, নিয়ত বাধাপ্রদানকারী পার্নেলের দলভুক্ত সদস্য ছিলেন।
ভারতীয় রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে লালমোহন ঘোষের বাগ্মিতা উচ্চাঙ্গের ছিল। সুরেন্দ্রনাথের যে সব মুদ্রাদোষ ছিল, লালমোহনের তাহা ছিল না। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ নব্য বঙ্গের যুবকদের আদর্শ ছিলেন এবং তাঁহার আবেগময়ী ওজস্বিনী বক্তৃতা যুবকদের চিত্তের উপর অসামান্য প্রভাব বিস্তার করিত। তাঁহার অদ্ভূত স্মরণশক্তিও ছিল। ভারতীয় জাতীয় মহাসভার পুনা অধিবেশনের প্রেসিডেণ্টরূপে তিনি অপূর্ব বক্তৃতা শক্তির পরিচয় প্রদান করেন। তিনি একটি বারও না থামিয়া তিন ঘণ্টা কাল অনর্গল বক্তৃতা করেন। তাঁহার হাতে যে মুদ্রিত অভিভাষণ ছিল, এক বারও তিনি তাহার সাহায্য গ্রহণ করেন নাই।
গোখেল বাগ্মী ছিলেন না, কিন্তু তাঁহার সাবলীল বক্তৃতা বহু তথ্যে পূর্ণ থাকিত। তিনি সংখ্যাসংগ্রহে নিপুণ ছিলেন, বক্তৃতায় অনাবশ্যক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করিতেন না। তাঁহার মনে আলোচ্য বিষয় সম্বন্ধে কোন সন্দেহ বা সংশয় থাকিত না, কেননা তথ্য সম্বন্ধে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। তিনি বাক্য সংযমের মূল্য বুঝিতেন এবং বেকনের প্রবন্ধের মত সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করিতেন। সুরেন্দ্রনাথের বক্তৃতা হৃদয়ের উপর, আর গোখেলের বক্তৃতা মস্তিষ্কের উপর প্রভাব বিস্তার করিত। ভারতের জাতীয়তাবাদের