পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৪৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

‘পলাতক’ জমিদার-পরিত্যক্ত গ্রাম—জলাভাব—গ্রামগুলি

কলেরা ও ম্যালেরিয়ার জন্মস্থান

 সেকালে অধিকাংশ জমিদারই আপন আপন প্রজাদের মধ্যে বাস করিতেন। যদিও তাঁহারা কখন কখন অত্যাচার করিতেন, তাহা হইলেও তাঁহাদের এই একটা গুণ ছিল যে, তাঁহারা প্রজাদের নিকট হইতে যাহা জোর জবরদস্তী করিয়া আদায় করিতেন, তাহা প্রজাদের মধ্যেই ব্যয় করিতেন, সুতরাং ঐ অর্থ অন্য দিক দিয়া প্রজাদের ঘরেই যাইত। কালিদাস তাঁহার রঘুবংশে খুব অল্প কথায় এই ভাবটি ব্যক্ত করিয়াছেন—

প্রজানামেবভূত্যর্থং স তাভ্যো বলিমগ্রহীৎ।
সহস্রগুণমুৎস্রষ্টু মাদত্তে হি রসং রবিঃ॥

 প্রজাদের মঙ্গলের জন্যই তিনি তাহাদের নিকট কর গ্রহণ করিতেন—রবি যেমন পৃথিবী হইতে রস গ্রহণ করে, তাহা সহস্র গুণে ফিরাইয়া দিবার জন্য (বৃষ্টি প্রভৃতি রূপে)।

 ১৮৬০ খৃষ্টাব্দের পর হইতেই জমিদারদের “কলিকাতা প্রবাস” আরম্ভ হয় এবং বর্তমানে ঐ ধনী সম্প্রদায়ের অধিকাংশ লোকই কলিকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। ১৮৩০ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই রংপুর, দিনাজপুর, রাজসাহী, ফরিদপুর, বরিশাল ও নোয়াখালির কতকগুলি বড় জমিদারী কলিকাতার ধনীদের হাতে যাইয়া পড়ে। সুতরাং ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে যে, ঐতিহাসিক জেমস্ মিল বিলাতের কমন্স সভায় সিলেক্ট কমিটির সম্মুখে ১৮৩১—৩২ খৃঃ সাক্ষ্যদানকালে নিম্নলিখিত মন্তব্য প্রকাশ করেন,—

 “জমিদারদের অধিকাংশই কি তাঁহাদের জমিদারীতে বাস করেন?—আমার বিশ্বাস, জমিদারদের অধিকাংশই জমিদারীতে বাস করেন না, তাঁহারা কলিকাতাবাসী ধনী লোক।

 “সুতরাং জমিদারী বন্দোবস্তের দ্বারা একটি ভূস্বামী ভদ্র সম্প্রদায় সৃষ্টির যে চেষ্টা হইয়াছিল, তাহা ব্যর্থ হইয়াছে—আমি তাহাই মনে করি।

 যোগীশ সিংহ বলিয়াছেন—“পূর্বে কারারুদ্ধ করিয়া খাজনা আদায়ের প্রথা ছিল। নীলামের প্রথা তাহা অপেক্ষা কম কঠোর হইলেও ইহার ফলে প্রাচীন অভিজাত সম্প্রদায়ের উপর কুঠারাঘাত করা হইল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হইবার ২২ বৎসরের মধ্যে বাংলার এক তৃতীয়াংশ এমন কি অর্ধেক জমিদারী নীলামের ফলে কলিকাতাবাসী ভূস্বামীদের হাতে পড়িল।”[]

 এই নিন্দনীয় প্রথা দেশের যে কি ঘোর অনিষ্ট করিয়াছে, তাহা বর্ণনা করা যায় না। ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে পুষ্করিণী খনন এবং বাঁধ বা রাস্তা নির্মাণ করা এদেশের চিরাচরিত


  1. প্রথম প্রথম যে জেলায় জমিদারী সেখানে উহা নীলাম হইত না, ‘বোর্ড অব রেভেনিউয়ের’ কলিকাতার আফিসে নীলাম হইত। এই কারণে বহু জাল জয়াচুরীর অবসর ঘটিত এবং নালামের কঠোরতা বৃদ্ধি পাইত। তখনকার “কলিকাতা গেজেটের” অধিকাংশই নীলামের বিজ্ঞাপনে পূর্ণ থাকিত। কখনও কখনও এজন্য অতিরিক্ত পত্রও ছাপা হইত।— সিংহ, “ইকনমিক অ্যানালস্‌স”, ফুটনোট, ২৭২ পৃঃ।
     দক্ষিণ সাহাবাজপুরে এবং হাতিয়াতে বহু পুষ্করিণী আছে। ঐ গুলি নির্মাণ করিতে নিশ্চয়ই বহু অর্থ ব্যয় হইয়াছে। পুষ্করিণীগুলির চারিদিকে সমুদ্রের লোণাজল প্রবেশ নিবারণ করিবার জন্য উচ্চ বাঁধ আছে।—“বাখরগঞ্জ”, ২২ পৃঃ।
     কাচুয়া হইতে অল্প দূরে কালাইয়া নদীর মুখের নিকটে একটি বৃহৎ পুষ্করিণী নির্মাণ করিবার জন্য কমলার নাম বিখ্যাত। পুষ্করিণীটি এখন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। কিন্তু যাহা অবশেষ আছে তাহাতেই বুঝা যায়, জেলার মধ্যে উহাই সর্বাপেক্ষা বড় পুষ্করিণী। বিখ্যাত দুর্গাসাগর হইতেও উহা আয়তনে বড়। —“বাখরগঞ্জ”,—৭৪ পৃঃ।