পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৪৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দ্বিতীয়, পরিচ্ছেদ
১৩

এই সব গ্রাম ম্যালেরিয়ার সৃষ্টি করে। যাহারা পারে, তাহারা সপরিবারে গ্রাম ত্যাগ করিয়া সহরে যাইয়া বাস করে। কলেজে শিক্ষিত সম্প্রদায় অন্যত্র কেরাণীগিরি করিয়া জীবিকা অর্জন করে, সুতরাং তাহারাও গ্রামত্যাগী, ভদ্রলোকদের মধ্যে যাহারা অলস ও পরজীবী তাহারা এবং কৃষকগণই কেবল গ্রামে থাকে। গ্রামত্যাগী জমিদারগণ কলিকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলে বাসা বাঁধিয়া বর্তমান ‘সভ্য জীবনের’ আধুনিকতম অভ্যাসগুলিও গ্রহণ করিয়াছে।[১]

 এই সব সভ্য জমিদারদের সুসজ্জিত বৈঠকখানায় স্বদেশজাত আসবাব প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহাদের “গ্যারেজে” “রোলস্ রয়েস” বা “ডজ” গাড়ী বিরাজ করে। আমি যখন এই কয়েক পংক্তি লিখিতেছি, তখন আমার মনে পড়িতেছে, একখানি জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রের কথা, ইহার পুরা এক পৃষ্ঠায় মোটরগাড়ীর বিজ্ঞাপন থাকে—উহার শিরোনামায় লিখিত থাকে—“বিলাস ও ঐশ্বর্যের আধার।” এই বিজ্ঞাপন আমাদের পাশ্চাত্য ভাবাপন্ন জমিদার ও ব্যারিষ্টারদের মন প্রলুব্ধ করে।

 বড় বড় ইংরাজ বণিক অথবা মাড়োয়ারী বণিকেরা এই সব বিলাস ভোগ করে বটে, কিন্তু তাহারা ব্যবসায়ী লোক। হয়ত ৫।৭টা জুট মিলের দালাল বা ম্যানেজিং এজেণ্টরূপে তাহাদিগকে বজবজ হইতে কাঁকিনাড়া পর্যন্ত দৌড়াইতে হয়। সুতরাং তাহাদের দৈনিক কার্যের জন্য তাহাদিগকে দুই একখানি মোটর গাড়ী রাখিতে হয়।[২] তাহারা যাহা ব্যয় করে, তাহা অপেক্ষা শত গুণ বা সহস্র গুণ অর্থ অর্জন করে। এবং বহুক্ষেত্রে তাহারা প্রকৃতই ধনোৎপাদক। কিন্তু আমাদের পাশ্চাত্যভাবাপন্ন জমিদারগণ বা বারের বড় ব্যারিষ্টারেরা পরজীবী মাত্র। তাহারা দেশের ধন এক পয়সাও বৃদ্ধি করে না, উপরন্তু দেশের কৃষকদের


  1. ১৮৫৪ খৃষ্টাব্দে অযোধ্যা বৃটিশ অধিকারভুক্ত হয়। ইতিমধ্যেই গ্রামত্যাগী জমিদার দল সেখানে দেখা দিয়াছে। “তাল,কদারেরা প্রজাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতার মত, এই কথার এখন কি মূল্য আছে? আমি বলিতে বাধ্য ষে, আমরা কোন কোন বয়স্ক প্রজাকে দেখিলাম, যাহারা সেকালের কথা এখনও স্মরণ করে। তখন তাহারা তাল,কদারের আশ্রয়ে বাস করিত। এই তালুকদারেরা জমিদারীতেই বাস করিত। তাহাদের চক্ষ-কর্ণ সর্বদা সজাগ থাকিত এবং নিজেরা ব্যতীত অন্য কাহাকেও প্রজাদের উপর অত্যাচার, উৎপীড়ন করিতে দিত না। কিন্তু তাহারা গত ৩০ বৎসরের মধ্যে লক্ষেই সহরে বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করিয়া বাস করিতেছে, আর নায়েব গোমস্তা প্রভৃতি অধস্তন কর্মচারীরা তাহাদের জমিদারী চালাইতেছে।—গোইন, “ইণ্ডিয়ান পলিটিক্স”—২৬২-৬৩ পূঃ।
     প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁহার “পল্লীসমাজে” বর্তমানকালের ভাব তাঁহার অনন,করণীয় ভাষা ও ভাবের দ্বারা অঙ্কিত করিয়াছেন।
     আর একখানি সদ্য প্রকাশিত উপন্যাসে (“বিদাৎলেখা”—এফ,প্রকুমার সরকার), বাঙ্গলার পল্লীর ‘ভদ্রলোক’ অধিবাসীদের কি গভীর অধঃপতন হইয়াছে, নিম্ন শ্রেণীর লোকদের অবস্থার উন্নতি করিবার চেষ্টা তাহারা কিরূপে প্রাণপণে প্রতিরোধ করে, এমন কি পুষ্করিণী-সংস্কার পর্ষন্ত করিতে দেয় না, এই সব কথা চিত্রিত হইয়াছে। এখানে নতন ভাব ও আদর্শ লইয়া একজন সংস্কার প্রয়াসী শিক্ষিত যুবক আসিয়াছেন, কিন্তু গ্রামবাসী গোঁড়ার দল তাঁহাকে শেষ পর্যন্ত গ্রাম হইতে বিতাড়িত করিল।
  2. লর্ড কেব্‌ল তাঁর মৃত্যু সময়ে বার্ড এণ্ড কোংর কর্তা ছিলেন এবং ঐ কোম্পানী ১৩টি মিল সহ ১১টি জুট মিল কোম্পানী পরিচালনা করিত।
     “যাহারা আজকাল মোটর গাড়ীতে ভ্রমণ করে, তাহাদের মধ্যে শতকরা দশজনও ভবিষ্যতের দিকে চাহিলে, মোটর গাড়ী রাখিতে পারে না”—জজ ক্রফোর্ড; ইনি বর্তমান যুগের বিলাসিতার তীব্র সমালোচক। পাঁচ বৎসর পূর্বে বার্ণেট নামক স্থানে তিনি বলেন,— “যদি ব্যক্তিগত সম্পত্তি না থাকে, তবে একজন কাউণ্টি কোর্ট জজেরও মোটর গাড়ী রাখিবার অধিকার নাই, কেননা কেবল মাত্র তাঁহার বেতন (বার্ষিক ১৫০০ পাউণ্ড) মোটর রাখিবার পক্ষে যথেষ্ট নহে।”
     জজ ক্রফোর্ড আরও বলেন, “আজকাল চারিদিকেই অমিতব্যয়িতার প্রভাব, যে সমস্ত লোক আদালতে আসে তাহারা নিজেদের ক্ষমতার অতিরিক্ত বিলাসে জীবন যাপন করে। লোকে ধারে বিবাহ করে এবং দেনার ও মামলায় জীবন কাটায়।”
     একজন শ্রমিক বালিকা ৪ শিলিং ১১ পেন্স মূল্যের দস্তানা পরিবে, ইহা তিনি কলঙ্কের ব্যাপার মনে করেন। এবং যখন তিনি শুনিলেন যে, তাহার জুতার মূল্য ১ পাউণ্ড, হ্যাট ১৩ শি, ১১ পে এবং কোট ৫ গিনি, তিনি সত্যই মর্মাহত হইলেন।
     ইংলণ্ডের মত ধনী দেশের পক্ষে যদি এই সব মন্তব্য প্রয়োগ করা হয়, তবে বলিতে হয়, আমাদের দেশে যাহারা মোটর গাড়ী ব্যবহার করে, তাহাদের মধ্যে হাজারকরা একজনেরও ঐরূপ বিলাসিতা করিবার অধিকার নাই।