তৃতীয় পরিচ্ছেদ
গ্রামে শিক্ষালাভ—কলিকাতায় গমন—কলিকাতা—অতীত ও বর্তমান
আমার নিজের জীবনের কথা আবার বলিতে আরম্ভ করিব। আমার দুই জ্যেষ্ঠভ্রাতা এবং আমি আমার পিতার প্রতিষ্ঠিত গ্রাম্যস্কুলে বাল্য শিক্ষালাভ করি। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা যখন মাইনর বৃত্তি পরীক্ষায় পাশ করেন, তখন এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হইল যে আমার পিতার ভবিষ্যৎ জীবনের গতি একেবারে পরিবর্তিত হইয়া গেল। সে কথা পরে বলিব। আমার নয় বৎসর বয়স পর্যন্ত আমি গ্রাম্য বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করি।
১৮৭০ খৃষ্টাব্দে আমি প্রথম কলিকাতায় আসি। তখন আমার মনে যে ভাব জাগিয়াছিল, তাহার স্মৃতি এখনও আমার মনে স্পষ্ট হইয়া আছে। আমার পিতা ঝামাপুকুর লেন এবং রাজা দিগম্বর মিত্রের বাড়ীর বিপরীত দিকে বাড়ী নেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদি ব্রাহ্মসমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া কেশবচন্দ্র সেন তখন সবেমাত্র তাঁহার নতুন ব্রাহ্মসমাজ প্রতষ্ঠিা করিয়াছেন। পিতার বাসা ঐ সমাজের খুব নিকটে ছিল। দিগম্বর মিত্রের অতিথিপরায়ণতা বিখ্যাত ছিল। তাঁহার বন্ধুরা সর্বদাই সেখানে সাদরে অভ্যর্থিত হইতেন এবং কয়েক বৎসর পর্যন্ত আমার পিতা প্রায়ই সেখানে আতিথ্য গ্রহণ করিতেন। পিতা পরবর্তী জীবনে প্রায়ই আমাদের নিকট দিগম্বর মিত্র এবং রাজেন্দ্রলাল মিত্র, হেমচন্দ্র কর, মুরলীধর সেন প্রভৃতি তখনকার দিনের অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তির কথা বলিতেন।
আমি আগষ্ট মাস মহানন্দে কলিকাতায় কাটাইলাম এবং প্রায় প্রতিদিনই নূতন নূতন দৃশ্য দেখিতাম। আমার চক্ষুর সম্মুখে এক নূতন জগতের দৃশ্য আবির্ভূত হইল। তখন নূতন জলের কল কেবল প্রবর্তিত হইয়াছে এবং সহরবাসীরা পরিষ্কৃত জল ব্যবহার করিতে আরম্ভ করিয়াছে। গোঁড়া হিন্দুরা অপবিত্রবোধে ঐ জল ব্যবহার করিতে তখনও ইতস্ততঃ করিতেছে। কিন্তু জলের বিশুদ্ধতা ও উৎকর্ষই শেষে জয়ী হইল। ক্রমে ক্রমে ন্যায়, যুক্তি এবং সুবিধা বোধ কুসংস্কারকে দূরীভূত করিল ও সর্বত্র উহার ব্যবহার প্রচলিত হইল। মাটির নীচের পয়ঃনালী নির্মাণ কেবলমাত্র আরম্ভ হইয়াছে।
১৮৭০ খৃষ্টাব্দে কলিকাতার অবস্থা কেমন ছিল তাহার চিত্র যদি এখনকার লোকের নিকট কেহ অঙ্কিত করে, তবে তাহারা হয়তো তাহা চিনিতেই পারিবে না। সহরের উত্তরাংশে দেশীয় লোকের বসতিস্থানে রাস্তার দুইধারে খোলা নর্দমা ছিল, আর তাহা হইতে জঘন্য দর্গন্ধ উঠিত। বাড়ীর সংলগ্ন পায়খানাগলি গলিত মলকুণ্ড ছিল বলিলেই হয়। ঐ গুলি পরিষ্কার করিবার ভার গৃহের অধিবাসীদের উপরই ছিল, আর সে ব্যবস্থা ছিল একেবারে আদিম যুগের। সহরবাসীরা অসীম ধৈর্য সহকারে মশা ও মাছির উপদ্রব সহ্য করিত।
সুয়েজ খাল তখন সবেমাত্র খোলা হইয়াছে। কিন্তু হুগলী নদীতে মাত্র কয়েকখানি সাগরগামী ষ্টিমার ছিল, তখনও অসংখ্য পালের জাহাজ ও তাহার মাস্তুলে হুগলী নদী আচ্ছন্ন। হাইকোর্ট এবং মিউজিয়ামের নূতন বাড়ী প্রায় শেষ হইয়া আসিয়াছে। তখনও কলিকাতায় কোন চিড়িয়াখানা হয় নাই। তবে “মার্বেল প্রাসাদের” রাজা রাজেন্দ্র মল্লিকের