পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৬
আত্মচরিত

বাড়ী একটা ছোটখাট চিড়িয়াখানা ছিল এবং বহু দর্শকের ভিড় সেখানে হইত। হুগলী নদীর ধারে তখন আধ ডজনেরও কম জুটমিল ছিল।[১]

 মাড়োয়ারী কর্তৃক বাঙ্গলার অর্থনৈতিক বিজয়ের লক্ষণ তখনও স্পষ্ট দেখা দেয় নাই। এই বিজয় অবশ্য একটি প্রবল যুদ্ধে করা হয় নাই, ক্রমে ক্রমে ধীরে, শান্তভাবে তাহারা বাঙ্গলা দেশকে আর্থিক যুদ্ধে পরাস্ত করিয়াছে।

 এক শতাব্দী পূর্বে মতিলাল শীল, রামদুলাল দে, অক্রুর দত্ত এবং আরও অনেকে আমদানী-রপ্তানীর ব্যবসায়ে ক্রোড়পতি হইয়াছিলেন। পরবর্তীকালে শিবকৃষ্ণ দাঁ এবং রাজা হৃষীকেশ লাহার পূর্বপুরুষ—প্রাণকৃষ্ণ লাহা যথাক্রমে আমদানী লৌহ ব্যবসায়ে এবং বস্ত্র ব্যবসায়ে প্রভূত ঐশ্বর্য সঞ্চয় করিয়াছিলেন। পুরাতন হিন্দু কলেজের অন্যতম প্রতিভাশালী ছাত্র ডিরোজিওর শিষ্য রামগোপাল ঘোষ, প্রসিদ্ধ বক্তা এবং রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তাঁহাকে বিলাতের এক পত্র “ভারতীয় ডেমস্‌থেনিস” এই আখ্যা দিয়াছিলেন। রামগোপাল ঘোষ তাঁহার অধিকাংশ সহাধ্যায়ীর মত সরকারী চাকুরী গ্রহণের জন্য ব্যগ্র হন নাই। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য আরম্ভ করেন এবং একজন ইংরাজ অংশীদারের সঙ্গে ‘কেলসাল ও ঘোষ’ নামে ফার্ম খুলেন।[২] রামগোপাল ঘোষের বন্ধু ও সতীর্থ প্যারীচাঁদ মিত্র সরকারী চাকুরী অপেক্ষা ব্যবসা-বাণিজ্যই বরণীয় মনে করিয়াছিলেন। তাঁহার আমেরিকার সঙ্গে ব্যবসায় ছিল। ব্রিটিশদের আগমনের প্রথম সময় হইতেই বাঙ্গালীরা ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ফার্মসমূহের ‘বেনিয়ান’ (মুৎসুদ্দি) ছিলেন এবং এই উপায়ে তাঁহারা বহু অর্থ সঞ্চয় করিয়াছেন। আমি যখন প্রথম কলিকাতায় আসি, তখন পর্যন্ত গোরাচাঁদ দত্ত, ঈশান বসু এবং অন্যান্য বিখ্যাত ‘বেনিয়ান’দের স্মৃতি বাঙ্গালীদের মধ্যে জাগ্রত ছিল। কিন্তু এই সব প্রথম আমলের বাঙ্গালী মহাজন এবং বেনিয়ানেরা নিজেদের বংশাবলীর জন্য ধ্বংসের বীজ বপন করিয়া গিয়াছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারী কিনিবার প্রলোভনে সহজেই তখনকার ধনীদের মন আকৃষ্ট হইত। আর এক দিকে “সূর্যাস্ত আইন” এবং অন্য দিকে মালিকদের আলস্য, বিলাসিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার জন্য জমিদারীও সর্বদা নীলামে চড়িত। জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতারা সাধারণতঃ স্বনামধন্য ব্যক্তি ছিলেন, নিজেদের শক্তিতে জমিদারী করিতেন, সুতরাং তাঁহারা প্রায়ই উচ্ছৃঙ্খল স্বভাবের লোক হইতেন না। কিন্তু তাঁহাদের বংশধরেরা “রূপার ঝিনুক” মুখে লইয়াই জন্মগ্রহণ করিত, নিজের চেষ্টায় কিছুই তাহাদের করিতে হইত না এবং ইহাদের চারিদিকে মোসাহেব ও পরগাছার দল ঘিরিয়া থাকিত। সুতরাং তাহারা যে বিলাসী ও উচ্ছৃঙ্খল হইত, ইহা আশ্চর্যের বিষয় নহে। তাহারা নিজেদের মানসিক উন্নতির জন্য কোন চেষ্টা করিত না, কেবল বিলাস-ব্যসনে ডুবিয়া থাকিত। “অলস মস্তিষ্ক সয়তানের কারখানা।” ডাঃ জনসনকে একবার জিজ্ঞাসা করা হয়,—“জ্যেষ্ঠাধিকারের পরিণাম কি?” তিনি উত্তর দেন যে, “ইহার ফলে পরিবারে কেবল


  1. ১৮৬০—৭০ এই দশ বৎসরে ৫টা মিল ৯৫০টি তাঁতসহ কার্য করিতেছে।—ওয়ালেশ, “রোমান্স অব জুট,” ২৬ পৃঃ।
  2. ছাত্রাবস্থাতেই অবকাশ সময়ে ঘোষ বাজারের অবস্থা এবং দেশের উৎপন্ন দ্রব্যজাতের বিষয় আলোচনা করিতে থাকেন। ২০ বৎসর বয়সের পূর্বেই তিনি মাল আমদানী শুল্কের সম্বন্ধে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন। প্রথমে বেনিয়ান, পরে অংশীদার রূপে একটি ইউরোপীর ফার্মে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়া তিনি নিজের ব্যবসা আরম্ভ করেন। তাঁহার ফার্মের নাম হইল আর, জি, ঘোষ এণ্ড কোং—রেঙ্গুনে ও আকিরাবে তাঁহার কোম্পানীর শাখা ছিল। তিনি ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করেন এবং বহু অর্থ উপার্জন করেন। বাকলাণ্ড— “Bengal under the Lt. Governors”—১০২৪ পৃঃ।