পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮
আত্মচরিত

তখনকার দিনে আমাদের গ্রাম হইতে কলিকাতায় আসিতে নৌকার ৩।৪ দিন লাগিত। কিন্তু বর্তমান রেলওয়ে ও ষ্টীমারযোগে পথের দূরত্ব কমিয়া গিয়াছে, এখন ১৪ ঘণ্টায় আমাদের গ্রাম হইতে কলিকাতায় আসা যায়। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শনাধীনে কোন প্রাসাদতুল্য হোটেল বা ‘মেস’ ছিল না। আমার পিতার সম্মুখে দুইটি মাত্র পথ ছিল। প্রথম, একজন শিক্ষক অভিভাবকের অধীনে কলিকাতায় তাঁহার ছেলেদের জন্য একটি পৃথক্ বাসা রাখা; দ্বিতীয়, গ্রাম হইতে নিজেরাই কলিকাতায় আসিয়া বাস করা এবং স্বয়ং ছেলেদের তত্ত্বাবধান করা। কিন্তু এই শেষোক্ত পথেও অত্যন্ত অসুবিধা ছিল। আমার পিতা বড় জমিদার ছিলেন না এবং উপযুক্ত বেতন দিয়া কোন বিশ্বস্ত কর্মচারীর উপর গ্রামের সম্পত্তির ভার ন্যস্ত করা তাঁহার পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। তাঁহার জমিদারী কতকগুলি ছোট ছোট তালুকের সমষ্টি ছিল এবং তিনি ব্যাঙ্কিং ও মহাজনীর কারবারও আরম্ভ করিয়াছিলেন। এই শেষোক্ত কারবারে তিনি সম্পত্তি বন্ধক রাখিয়া বহু লোককে টাকা ধার দিয়াছিলেন। সুতরাং তাঁহার পক্ষে গ্রামে থাকিয়া ঐ সমস্ত সম্পত্তি ও কারবার নিজে দেখা অপরিহার্য ছিল। দীর্ঘকালের জন্য গ্রাম ছাড়িয়া দূরে বাস করা তাঁহার পক্ষে স্বভাবতই ঘোর ক্ষতিকর। কোন্ পথ অবলম্বন করা হইবে, তাহা লইয়া আমাদের পরিবারে আলোচনা চলিতে লাগিল। আমার মনে আছে, পিতা ও মাতার মধ্যে ইহা লইয়া প্রায়ই আলোচনা হইত এবং এ বিষয়ে কোন নিশ্চিত মীমাংসা করা তাঁহাদের পক্ষে কঠিন ছিল। অবশেষে স্থির হইল যে, পিতামাতাই ছেলেদের লইয়া কলিকাতায় থাকিবেন, অন্যথা অল্পবয়স্ক ছেলেদের পক্ষে বিদেশে বাসা প্রভৃতির বন্দোবস্ত করিয়া থাকা অসম্ভব।

 আমার পিতা তাঁহার পল্লীজীবনের একটি অভাবের কথা বলিয়া প্রায়ই ক্ষোভ প্রকাশ করিতেন। পল্লীর যে ভদ্রসমাজের মধ্যে তাঁহাকে বাস করিতে হইত, তাহার বিরুদ্ধে তিনি অনেক সময়ই অভিযোগ করিতেন। পল্লীর ভদ্রলোকেরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জগতে বাস করিতেন। হাফেজ, সাদি এবং বিখ্যাত ইংরাজ সাহিত্যিকদের গ্রন্থ পাঠে যাঁহার মন ও চরিত্র গঠিত হইয়াছিল, যিনি রামতনু লাহিড়ীর পদমূলে বসিয়া শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন, তিনি শিক্ষায় অর্ধশতাব্দী পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারগ্রস্ত ও গোঁড়ামিতে পূর্ণ লোকদের সংসর্গে আনন্দলাভ করিবেন, ইহা প্রত্যাশা করা যায় না। দুই একটি দৃষ্টান্ত দিলে আমার বক্তব্য পরিস্ফুট হইবে।

 বিদ্যাসাগর মহাশয় যে বিধবা-বিবাহ আন্দোলন আরম্ভ করেন, তাহা নব্য বাঙ্গলার মন অধিকার করিয়াছিল এবং আমার পিতা এ বিষয়ে তাঁহার উৎসাহ কার্যতঃ প্রমাণ করিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন। আমাদের গ্রামের স্কুলে মোহনলাল বিদ্যাবাগীশ নামক একজন পণ্ডিত ছিলেন। টোলে-পড়া শিক্ষিত ব্রাহ্মণ হইলেও, তিনি তাঁহার পৈতা ত্যাগ করিয়াছিলেন। এই পণ্ডিত সহজেই বিধবা বিবাহ করিতে সম্মত হইলেন।

প্রাচীন ও নবীন

 এই “ধর্ম-বিরুদ্ধ” বিবাহের কথা দাবানলের ন্যায় চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িল এবং শীঘ্রই যশোরে আমার পিতামহের কাণে যাইয়া পৌঁছিল। পিতামহ গোঁড়া হিন্দু ছিলেন, সুতরাং এই ‘ঘোর অপরাধের’ কথা শুনিয়া তিনি স্তম্ভিত হইলেন। তিনি পাল্কীর ডাক বসাইয়া তাড়াতাড়ি যশোর হইতে রাডুলিতে আসিলেন এবং বিধবা বিবাহ বন্ধ করিতে আদেশ দিলেন। আমার পিতাকে বাধ্য হইয়া এই আদেশ মানিতে হইল এবং বিধবা বিবাহ দেওয়া আর ঘটিল না।