পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

কলিকাতায় শিক্ষালাভ

 ১৮৭০ খৃষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আমার পিতামাতা স্থায়ীভাবে কলিকাতায় আসিলেন এবং ১৩২নং আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাড়ী ভাড়া করিলেন। আমরা এই বাড়ীতে প্রায় দশ বৎসর বাস করিয়াছিলাম।[১] আমার বাল্যকালের সমস্ত স্মৃতিই ঐ বাড়ী এবং চাঁপাতলা নামে পরিচিত সহরের ঐ অঞ্চলের সঙ্গে জড়িত। আমার পিতা আমাকে ও জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে হেয়ার স্কুলে ভর্তি করিয়াছিলেন। হেয়ার স্কুল তখন ভবানীচরণ দত্তের লেনের সম্মুখে একটি একতলা বাড়ীতে অবস্থিত ছিল। এখন ঐ বাড়ী প্রেসিডেন্সী কলেজের রসায়ন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে।

 আমার সহাধ্যায়ীরা যখন জানিতে পারিল যে, আমি যশোর হইতে আসিয়াছি, তখন আমি তাহাদের বিদ্রুপ ও পরিহাসের পাত্র হইয়া উঠিলাম। আমাকে তাহারা ‘বাঙাল’ নাম দিল এবং মন্দভাগ্য পূর্ববঙ্গবাসীদের যে সব ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে বলিয়া শোনা যায়, তাহার সবই আমার ঘাড়ে চাপানো হইল। এক শতাব্দী পূর্বে স্কটল্যাণ্ডের বা ইয়র্কশায়ারের কোন গ্রাম্য বালক তাহার কথার বিশেষ ‘টান’ এবং ভাব-ভঙ্গীর বিশেষত্ব লইয়া যখন লণ্ডন সহরের বালকদের মধ্যে উপস্থিত হইত, তখন তাহার অবস্থাও কতকটা এই রকমই হইত। তখনকার দিনে জাতীয় জাগরণ বলিয়া কিছুই হয় নাই; সুতরাং অল্প লোকেই জানিত যে, আমার জেলা এমন দুই জন মহাযোদ্ধাকে জন্ম ও আশ্রয় দিয়াছে—যাঁহারা মোগল বাদশাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করিয়াছিলেন। অন্যথা বিদ্রুপকারীদিগকে আমি এই বলিয়া নিরুত্তর করিতে পারিতাম যে, রাজা প্রতাপাদিত্যের সামরিক অভিযানের ক্ষেত্রসমূহ আমার গ্রামের অতি নিকটে এবং রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী মহম্মদপুর আমার জেলাতেই অবস্থিত। বাঙ্গলার তদানীন্তন সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত কবি এবং অমিত্রাক্ষর ছন্দের জন্মদাতা “বাংলার মিল্‌টন” আমাদেরই গ্রামের দৌহিত্র এবং তৎকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র আমাদের জেলাতেই জন্মগ্রহণ করেন এবং স্তন্যপানে পুষ্ট হন—এসব কথা বলিয়াও আমি বিদ্রুপকারীদের নিরস্ত করিতে পারিতাম।

 কলিকাতা আসিবার পূর্বে আমার মানসিক উন্নতি কিরূপ হইয়াছিল, সেকথা এখানে একটু বলিব। পিতার সঙ্গে আমাদের (আমি ও আমার ভাইদের) সম্বন্ধ সরল ও সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। বই পড়া অপেক্ষা পিতার সঙ্গে কথা বলিয়া আমরা অনেক বিষয় বেশী শিখিতাম। তাঁহার নিকটে গিয়া কথাবার্তা বলিতে ও গল্পাদি করিতে তিনি আমাদের সর্বপ্রকার সুযোগ দিতেন। আমি অনেক সময় দেখিয়াছি, পিতা ও পুত্রের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য ব্যবধান, পুত্র পিতাকে ভয় করিয়া চলে, দুই জনের মধ্যে যেন একটা রুক্ষ্ম নীরবতার সম্বন্ধ বর্তমান। মাতা অথবা পরিবারের কোন বন্ধু পিতা ও পুত্রের মধ্যে অনেক


  1. ঐ বাড়ীর এখনও সেই পুরাতন নম্বর আছে।