পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
২১

সময়ই মধ্যস্থের কার্য করেন। আমার পিতা সৌভাগ্যক্রমে চাণক্য পণ্ডিতকেও অতিক্রম করিয়াছিলেন।

লালয়েৎ পঞ্চবর্ষাণি দশবর্ষাণি তাড়য়েৎ।
প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রমিত্রবদাচরেৎ॥

 ইহাই চাণক্যের উপদেশ। কলিকাতা আসার পূর্বে আমি যখন গ্রাম্য স্কুলে পড়িতাম এবং আমার বয়স মাত্র নয় বৎসর, সেই সময়ে ইতিহাস ও ভূগোলের প্রতি আমার অনুরাগ ছিল। একদিন পিতার ভূগোলের জ্ঞান পরীক্ষা করিতে আমার মনে ইচ্ছা হইল। আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সিবাস্টপুল কোথায়? তিনি বলিলেন,—‘কি সিবাস্টপুলের কথা বলিতেছ? ইংরাজেরা ঐ সহর কিরূপে অবরোধ করিল, তাহা আমি যেন চোখের সম্মুখে দেখিতেছি।’ এই উত্তর শনিয়া আমি নীরব হইলাম।

 আর একবার ইংরাজের দেশপ্রেম ও কর্ত্তব্যবোধের কথা বলিতে গিয়া তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন, যাহা আমাদের যুবকদের সর্বদা স্মরণ রাখা উচিত। সিপাহী বিদ্রোহ আরম্ভ হইয়াছে। স্যর কলিন কাম্প্‌বেল (পরে লর্ড ক্লাইভ) তখন ছুটিতে আছেন এবং এডিনবার্গ ফিলজফিক্যাল ইনষ্টিটিউটে বসিয়া সংবাদপত্র পড়িতেছেন। ইণ্ডিয়া অফিস হইতে তারযোগে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তিনি ভারতে যুদ্ধে যাইতে প্রস্তুত আছেন কিনা? তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন—“হাঁ”। কয়েক মিনিট পরেই আবার তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, কখন তিনি যাত্রা করিবার জন্য প্রস্তুত হইবেন? তিনি উত্তর দিলেন “এই মুহূর্তে!”

 আমার পিতার মুখ হইতেই আমি প্রথম শিখি যে, প্রাচীন ভারতে গো-মাংস ভক্ষণ বেশ প্রচলিত ছিল এবং সংস্কৃতে অতিথির এক নামই হইল “গোঘ্ন” (যাঁহার কল্যাণার্থ গোহত্যা করা হয়)।[১] আমার মনে পড়ে তাঁহার মুখেই এই দুইখানি বহির নাম আমি প্রথম শুনি (Young’s ‘Night Thoughts’ and Bacon’s ‘Novum Organum’)। নাম দুইটি আমার কাছে অর্থহীন বোধ হইয়াছিল, ইহা আমি স্বীকার করিতেছি। কয়েক বৎসর পরে আলবার্ট স্কুলে আমি যে সব গ্রন্থ পুরস্কার পাই, তাহার মধ্যে একখানি ছিল এই ‘Night Thoughts’, আমার মন কৌতুহলপ্রবণ ছিল। পড়োশানাতেও আমার অনুরাগ ছিল। সেইজন্য আমি প্রায়ই পিতার গ্রন্থাগারের বইগুলি নাড়াচাড়া করিতাম। জন্‌সনের ডিক্সনারী দুই কোয়ার্টো ভালম, টড কর্তৃক সম্পাদিত এবং ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত এই বইখানি আমার চিত্ত আকৃষ্ট করিয়াছিল। ইহার মধ্যে প্রাচীন ও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের লেখা হইতে যে সব উদ্ধৃতাংশ ছিল, তাহা আমার খুব ভাল লাগিত। আমি এই গ্রন্থের পাতা উল্টাইতাম এবং উদ্ধৃতাংশ মঞ্চস্থ করিতাম, যদিও “Shak.” ‘Beau. and Fl’. এই সব সাঙ্কেতিক চিহ্নের অর্থ আমি বুঝিতাম না। একদিন আমি নিম্নলিখিত পংক্তিগুলি মুখস্থ করিলাম—

 “Ignorance is the curse of God, knowlege the wing wherewith we fly to heaven.”—Shak. আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শুনিয়া বিস্মিত ও আনন্দিত হইলেন।


  1. রাজেন্দ্রলাল মিত্রের কয়েকটি প্রবন্ধ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছে “Beef Eating in Ancient India” (চক্রবর্তী, চাটার্জি এণ্ড কোং); “প্রাচীন ভারতে গো-মাংস” নামক গ্রন্থ দ্রষ্টব্য।