পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৪
আত্মচরিত

বলিয়া মনে হইত। বাধ্যতামূলক বৈধব্য, বাল্য বিবাহ এবং ঐ শ্রেণীর অন্যান্য প্রথা আমার নিকট জঘন্য বলিয়া বোধ হইত। আমার পিতা প্রায়ই বলিতেন যে, তাঁহার অন্ততঃ একটি ছেলে বিধবা বিবাহ করিবে এবং আমাকেই তিনি এই কার্যের উপযুক্ত মনে করিতেন। ব্রাহ্ম সমাজের সমাজ-সংস্কারের দিকটাই আমার মনের উপর বেশী প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল।

 কেশবচন্দ্র সেন ১৮৭১ খৃষ্টাব্দে বিলাত হইতে ফিরিয়া “সুলভ সমাচার” নামক এক পয়সা মূল্যের সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। এই কাগজে অনেক নূতন ভাব থাকিত। কেশবচন্দ্রের নূতন সমাজ—ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজে প্রতি রবিবার সন্ধ্যায় আমি তাঁহার ধর্মোপদেশ শুনিতে যাইতাম। আদি ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে বিচ্ছেদের পর কেশবচন্দ্রই এই নূতন সমাজ স্থাপন করেন। কেশবচন্দ্রের গম্ভীর ওজম্বিনী কণ্ঠস্বরের ঝঙ্কার এখনও আমার কানে রাজিতেছে। টাউন হলে কিম্বা ময়দানে বা অ্যালবার্ট হলে কেশবচন্দ্রের বক্তৃতা শনিবার সুযোগ আমি কখনই ত্যাগ করিতাম না।

 ১৮৭৪ সাল আমার জীবনের একটি গুরুতর ঘটনাপূর্ণ বৎসর। আমি সেই সময় ৪র্থ শ্রেণীতে পড়িতাম। আগষ্ট মাসে আমার গুরুতর রক্তামাশয় রোগ হইল এবং ক্রমে ঐ রোগ এত বাড়িয়া উঠিল যে, আমাকে স্কুলে যাওয়া ত্যাগ করিতে হইল। এ পর্যন্ত আমার স্বাস্থ্য ভাল ছিল, পরিপাকশক্তি বা ক্ষুধারও কোন গোলযোগ ছিল না। আমি পৈতৃক অধিকারে সবল ও সুগঠিত দেহ পাইয়াছিলাম। কিন্তু আমার ব্যাধি ক্রমে স্থায়ী রোগ হইয়া দাঁড়াইল এবং যদিও সাত মাস পরে তাহার তীব্রতা কিছু হ্রাস পাইল, তথাপি আমার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া গেল এবং পরিপাকশক্তি নষ্ট হইল। আমি ক্রমে দুর্বল হইয়া পড়িলাম এবং তরুণ বয়সেই আমার শরীর আর বাড়িল না। আমি বাধ্য হইয়া আমার আহার সম্বন্ধে কড়াকড়ি নিয়ম মানিয়া চলিতে কৃতসংকল্প হইলাম।

 এক বিষয়ে এই ব্যাধি আমার পক্ষে আশীর্বাদ স্বরূপ হইল। আমি সব সময়েই লক্ষ্য করিয়াছি যে, ক্লাশে ছেলেদের পড়াশনা বেশীদদূর অগ্রসর হয় না। কতকগুলি ছেলের বুদ্ধি প্রখর নহে, কতকগুলির বুদ্ধি মাঝারি গোছের, আর অল্পসংখ্যক ছেলের বুদ্ধিই উচ্চশ্রেণীর থাকে। এই সব রকম ছেলেকেই একসঙ্গে শিক্ষা দেওয়া হয়, ফলে ইহাদের সকলের বুদ্ধি ও মেধার গড়পড়তা অনুসারে পড়াশুনার উন্নতি হয়; তার বেশী হয় না। ক্লাশে এক ঘণ্টা বক্তৃতা ৪৫ মিনিটের বেশী নহে, তার মধ্যে ছেলেদের হাজিরা ডাকিতেই প্রায় ১০ মিনিট সময় যায়। ইটন, রাগবী, হ্যারো প্রভৃতির মত ইংরাজী স্কুলে এমন অনেক সুবিধা আছে, যাহার ফলে এই সব ত্রুটির অন্য দিক দিয়া সংশোধন হয়। ঐ সব স্কুলে ছেলেরা এমন অনেক বিষয় শিখে, যাহা অমূল্য এবং যাহার ফলে তাহাদের চরিত্র গঠিত হয়। বই পড়িয়া যাহা শেখা যায় না, এরূপ সব বিষয়ে সেখানে তাহারা শিখে। ‘ওয়াটারলুর যুদ্ধ ইটন স্কুলের ক্রীড়াক্ষেত্রেই জিত হইয়াছিল’— ওয়েলিংটনের এই উক্তির মধ্যে অনেকখানি সত্য নিহিত আছে। এই সব স্কুলের হেডমাষ্টারদের অনেক সময় বিশপের পদে অথবা অক্সফোর্ড´ বা কেম্ব্রিজের মাষ্টারের পদে উন্নতি হয়। এইরূপ স্কুল একজন আর্নল্ড—অন্ততপক্ষে বাটলারের—গর্ব করিতে পারে।[১] কিন্তু বাঙ্গালী ছেলেরা সাধারণতঃ যে সব স্কুলে পড়ে, তাহাদের এমন কোন সুবিধা নাই। এখানে তাহাকে এমন এক ভাষায়


  1. সাম্রাজ্যের প্রথম বার্ষিক বিশ্ববিদ্যালয় সম্মিলনীতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধিরূপে গিয়া সার দেবপ্রসাদ সর্বাধিকারী এবং আমি কেম্ব্রিজ ট্রিনিটি কলেজের মাষ্টার ডাঃ বাটলারের গৃহে অতিধি হইয়াছিলাম।