পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
২৫

শিক্ষালাভ করিতে হয়, যাহা তাহার মাতৃভাষা নহে এবং ইহাই তাহার উন্নতির পক্ষে একটা প্রধান বাধা স্বরূপ।

 ছেলে যদি ক্লাশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছাত্র হয়, তাহা হইলেও ক্লাশে তাহার পড়াশুনার উন্নতি ধীর গতিতে হইতে বাধ্য। অজ্ঞাতসারে তাহার মনে একটা গর্ব হয়, কোন কোন সময়ে সে আত্মম্ভরী হইয়া উঠে। বাস্তবিক পক্ষে সে কতটুকু শিখে— অতি সামান্যই। অনেক সময় সে ভাবে যে, যাহা তাহাকে শিখিতে হইবে, তাহা তাহার পাঠ্য পুস্তকের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর মধ্যেই আছে। তাহার জ্ঞান-ভাণ্ডার অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। এতদ্ব্যতীত, প্রখর বুদ্ধিশালী ছাত্র যেটকু তাহার পক্ষে একান্ত প্রয়োজন, সেইটুকু আয়ত্ত করিবার কৌশল শিখে। ক্লাশের প্রধান ছাত্রই যে সব সময়ে সর্বোৎকৃষ্ট ছাত্র, ইহাও সত্য নহে; যদিও কোন কোন সাধারণ শিক্ষক তাঁহার সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির দ্বারা সেইরূপ মনে করিতে পারেন বটে।

 লর্ড বায়রণ এবং আমাদের রবীন্দ্রনাথ—অঙ্কে অত্যন্ত কাঁচা ছিলেন এবং সেই কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁহাদের সাফল্যের পথ রুদ্ধ হইয়াছিল। স্যর ওয়াল্টার স্কটের শিক্ষক ভবিষ্যৎ বাণী করিয়াছিলেন যে, তিনি (স্কট) একজন গর্দ্দভ এবং চিরজীবন গর্দ্দভই থাকিবেন। এডিসনের শিক্ষক তাঁহাকে তাঁহার মাতার নিকট এই বলিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিলেন যে, তিনি (এডিসন) অত্যন্ত নির্বোধ।

 শিক্ষার আরও উচ্চ স্তরে যাওয়া যাক। প্রায় দেড় শত জন “সিনিয়ার র‍্যাংলারের” জীবন আলোচনা করিয়া দেখা গিয়াছে যে, পরবর্তী জীবনে তাঁহাদের অধিকাংশের কৃতিত্ব সম্বন্ধে কোন কথা শোনা যায় নাই, তাঁহারা বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকরূপে জীবনযাপন করিয়াছেন মাত্র।

 যাহা হউক, এইরূপে স্কুলের বৈচিত্র্যহীন শুষ্ক পাঠ্যপ্রণালী হইতে মুক্ত হইয়া আমি মনের সাধে নিজের ইচ্ছানুযায়ী অধ্যয়ন করিবার সুযোগ লাভ করিলাম। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা এই সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র ছিলেন, তিনি পিতার লাইব্রেরীতে আরও বহু মূল্যবান পস্তক সংগ্রহ করিলেন। লেথব্রিজের ‘Selections from Modern English Literature’ তখন প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের পাঠ্য ছিল। এই বহি আমার এত প্রিয় ছিল যে ইহা আগাগোড়া কয়েকবার পড়িয়াছি। Selections পড়িয়া আমার জ্ঞানতৃষ্ণা মিটিল না, কিন্তু ইহা ইংরাজী সাহিত্যের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সোপানস্বরূপ হইল। গোল্ডস্মিথের ‘Vicar of Wakefield’ আমি পুনঃপুনঃ পাঠ করিলাম এবং উহার প্রত্যেক চরিত্রই আমার নিকট পরিচিত হইয়া উঠিল। স্কোয়ার থর্ণহিল, মিঃ বার্চেল, অলিভিয়া, সোফিয়া, মোসেস এবং সেই অননুকরণীয় গীতি—‘দি হারমিট’ এবং অলিভিয়ার সেই বিলাপ-গীতি— ‘When lovely woman stoops to folly’ —অর্ধ্বশতাব্দী পূর্বে আমার যেরূপ মনে ছিল, এখনও সেইরূপ আছে। ইহা বিশেষরূপে উল্লেখযোগ্য, কেন না ইংরাজ পাদরীর পারিবারিক জীবন সম্বন্ধে আমার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না। বহু বৎসর পরে ইংলণ্ডে অবস্থানকালে জর্জ ইলিয়টের ‘Scenes from Clerical Life’ ঐ ভাবে আমাকে মুগ্ধ করিয়াছিল। বস্তুতঃ মানব-প্রকৃতি দেশ-কাল-জাতিধর্মনির্বিশেষে, সর্বত্রই এক এবং কবির প্রতিভা যেখানে মানব-প্রকৃতির গভীর রহস্য ব্যক্ত করে, তখন তাহা সকলেরই হৃদয় স্পর্শ করে। “স্পেক্টেটর” হইতে কতকগুলি প্রবন্ধ এবং জন্‌সনের ‘রাসেলাস’ও আমি পড়িয়াছিলাম। ‘রাসেলাসের’ প্রথম প্যারা— Ye, who listen with credulity ইত্যাদি আমি এখনও অক্ষরে অক্ষরে আবৃত্তি করিতে পারি। শীঘ্রই আমি উচ্চশ্রেণীর ইংরাজী সাহিত্যের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়িলাম। নাইটের ‘Half-hours with the Best Authors’ এই বিষয়ে আমাকে সহায়তা করিয়াছিল।