সেক্সপীয়রের জুলিয়াস সীজর, মার্চেণ্ট অব ভিনিস এবং হ্যামলেটের কতকগুলি নির্বাচিত অংশ (যথা—Soliloquy) আমার সম্মুখে নূতন জগতের দ্বার খুলিয়া দিল এবং পরবর্তী জীবনে মহাকবির বহিগুলি যতদূর পারি পড়িব, ইহাই আমার অন্যতম আকাঙ্ক্ষা হইল।
এই সময়ে বাঙ্গলা সাহিত্যে নবযুগের প্রবর্তক “বঙ্গদর্শন” মাসিক পত্র প্রকাশিত হইল। ইহাতে বঙ্কিমচন্দ্রের “বিষবৃক্ষ” ধারাবাহিকরূপে বাহির হইতেছিল। যদিও সেই অল্পবয়সে নিপুণহস্তে অঙ্কিত মানব-চরিত্রের ঐ সব সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ আমি বুঝিতে পারিতাম না, তবুও কেবল গল্পের আকর্ষণে আমি ঐ প্রসিদ্ধ উপন্যাস অসীম ঔৎসুক্যের সঙ্গে পড়িতাম। প্রফুল্লচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের— ‘বাল্মীকি ও তাঁহার যুগ’ এবং রামদাস সেনের ‘কালিদাসের যুগ’ আমার মন পুরাতত্ত্বের দিকে আকৃষ্ট করিল। এখানে বলা আবশ্যক যে, “বিবিধার্থ-সংগ্রহে” রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘বাঙ্গলার সেনরাজগণ’ ও ঐ শ্রেণীর অন্যান্য প্রবন্ধ বাংলার পুরাতত্ত্ব আলোচনার সূত্রপাত করে। তখন কল্পনা করি নাই যে, পুরাতত্ত্বের প্রতি আমার এই আকর্ষণ পরবর্তিকালে “হিন্দু রসায়নশাস্ত্রের ইতিহাস” রচনাকার্যে আমাকে সহায়তা করিবে।
‘বঙ্গদর্শনের’ দৃষ্টান্তে যোগেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ কর্তৃক সম্পাদিত ‘আর্যদর্শন’ প্রকাশিত হইল। এই পত্রিকার প্রধান বিশেষত্ব ছিল, জন ষ্টুয়ার্ট মিলের আত্মচরিতের অনুবাদ। উহা আমার মনের উপর গভীর রেখাপাত করিল। একটা বিষয় আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিলাম। জেমস্ মিল তাঁহার প্রতিভাশালী পুত্রকে কোন সাধারণ স্কুলে পাঠান নাই এবং নিজেই তাহার বন্ধু ও শিক্ষক হইয়াছিলেন। অল্পবয়সে জন ষ্টুয়ার্ট মিলের বুদ্ধিবৃত্তির অসাধারণ বিকাশের ইহাই কারণ মনে করা যাইতে পায়ে। মাত্র দশ বৎসর বয়সে জন ষ্টুয়ার্ট মিল লাটিন ও গ্রীক ভাষা, পাটীগণিত এবং ইংলণ্ড, স্পেন ও রোমের ইতিহাস শিখিয়া ফেলিয়াছিলেন।
পাঠে অনুরাগ
আমি তখনকার দিনের তিনখানি প্রধান সাপ্তাহিক পত্রের নিয়মিত পাঠক ছিলাম— দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত ‘সোমপ্রকাশ’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ (তখন ইংরাজী ও বাংলা উভয় ভাষায় প্রকাশিত হইত) এবং কৃষ্ণদাস পাল কর্তৃক সম্পাদিত ‘হিন্দু পেট্রিয়ট’। ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’র শ্লেষপূর্ণ মন্তব্য এবং সরকারী কর্মচারীদের স্বেচ্ছাচারের তীব্র সমালোচনা আমি খুব উপভোগ করিতাম। নরেন্দ্রনাথ সেন ও কৃষ্ণবিহারী সেনের যুগ্ম সম্পাদকতায় প্রকাশিত ‘ইণ্ডিয়ান মিরর’ তখন এ অঞ্চলে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয়দের কর্তৃত্বে পরিচালিত একমাত্র ইংরাজী দৈনিক ছিল। এই কাগজ পাইবার জন্য আমার এত আগ্রহ ছিল যে, ক্লাশ আরম্ভ হইবার একঘণ্টা পূর্বে আমি অ্যালবার্ট হলে উহা পড়িবার জন্য যাইতাম ৷
এখানে এমন একটি ঘটনা বর্ণনা করিব, যাহা আমার জীবনের গতি ও প্রকৃতি পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছিল। একদিন আমি আমাদের গ্রন্থাগারে স্মিথের Principia Latina নামক একখানি বহি দেখিলাম। বহিখানি নিশ্চয়ই আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কোন পুরাতন পুস্তকের দোকান হইতে কিনিয়া আনিয়াছিলেন। কয়েকপাতা উল্টাইয়াই আমি বিস্মিত ও আনন্দিত হইলাম। ইহাতে যে সব পদ ও বাক্য ছিল, চেষ্টা করিয়া তাহার অর্থবোধ আমার হইল। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা আমার পড়া ছিল।