পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
২৯

অনুপস্থিত ছিলাম, সুতরাং সে হিসাবে আমি আমার সহপাঠীদের পিছনে পড়িয়াছিলাম। স্কুলের সেসনও তখন অনেক দূর অগ্রসর হইয়াছে। বৎসরের অবশিষ্ট সময়ের জন্য আমি অ্যালবার্ট স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হইলাম। ঐ স্কুল তখন সবেমাত্র কেশবচন্দ্র সেন এবং তাঁহার সহকর্মীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং স্বভাবতই ইহার প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ ছিল। কেশবচন্দ্রের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কৃষ্ণবিহারী এই স্কুলের ‘রেকটর’ (কার্যতঃ হেড মাষ্টার) ছিলেন। কিন্তু সে সময়ে তিনি অল্প কিছুকালের জন্য জয়পুরে মহারাজার কলেজের প্রিন্সিপাল হইয়া গিয়াছিলেন। কৃষ্ণবিহারীর স্থানে শ্রীনাথ দত্ত কাজ করিতেছিলেন। শ্রীনাথ দত্ত লণ্ডনে এবং সাইরেনচেষ্টারে কৃষি-বিদ্যার শিক্ষা সমাপ্ত করিয়া কিছুদিন হইল দেশে ফিরিয়াছেন। এই স্কুলে আমি আমার মনের মত পারিপার্শ্বিক অবস্থা পাইলাম। শিক্ষকেরা সকলেই ব্রাহ্ম সমাজের লোক। কেশবচন্দ্র যখন জাতিভেদ ত্যাগ করিয়া আদি ব্রাহ্ম সমাজ হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া নূতন সমাজ স্থাপন করিলেন, তখন এই শিক্ষকেরা তাঁহার পতাকাতলে আসিয়া সমবেত হইলেন। এই সব সংস্কারের অগ্রদূতগণকে কিরূপ সামাজিক নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল, তাহা এখনকার যুবকগণ ধারণা করিতে পারিবেন না। যাঁহারা পিতামাতার প্রিয় সন্তান, তাঁহাদের আশাভরসার স্থল, তাঁহাদিগকে অনেক ক্ষেত্রে পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া অন্যত্র আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইয়াছিল। কিন্তু তাঁহারা সাহসের সঙ্গে সানন্দচিত্তে কোন দ্বিধা বা আপত্তি না করিয়া এই সমস্ত সহ্য করিয়াছিলেন। এই স্কুলে ভর্তি হইবার পর দুই মাস যাইতে না যাইতেই, সকলে আমার কথা লইয়া আলোচনা করিতে লাগিল। আমার শিক্ষকেরা শীঘ্রই বুঝিতে পারিলেন যে আমার সহপাঠীদের অপেক্ষা আমি সকল বিষয়েই শ্রেষ্ঠ এবং অল্পবয়সে আমার এই অনন্যসাধারণ কৃতিত্ব সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। যখনই Etymology বা শব্দরূপ সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন উঠিত, আমি তৎক্ষণাৎ তাহার মৌলিক অর্থ বলিয়া দিতে পারিতাম। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, হোয়াইটের Natural History of Selborne হইতে উদ্ধৃত একটি লাইনে nidification এই শব্দটী ছিল। আমার ল্যাটিনের সামান্য জ্ঞান হইতে ঐ ভাষার সহিত সংস্কৃতের সাদৃশ্য উপলব্ধি করিয়াছিলাম।

Nidus = Nidas (সংস্কৃত নীড়)
Decem = Dasam (সংস্কৃত দশম)

 কিন্তু পরবর্তী সেসন হইতে হেয়ার স্কুলে ফিরিয়া যাইবার জন্য আমি মনে মনে আশা পোষণ করিতেছিলাম। ইহার প্রতিষ্ঠাতার নামের সঙ্গে বহু গৌরবময় স্মৃতি জড়িত ছিল এবং শিক্ষাজগতে এই স্কুল একটা নিজস্ব ধারাও গড়িয়া তুলিয়াছিল। পক্ষান্তরে অ্যালবার্ট স্কুল নূতন স্থাপিত হইয়াছিল এবং এই স্কুল হইতে কোন প্রতিভাশালী খ্যাতনামা ছাত্রও বাহির হয় নাই। সুতরাং আমি ক্লাশের বার্ষিক পরীক্ষা দিলাম না। পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করিয়া পুরস্কার লাভ করিব, এ বিশ্বাস আমার ছিল; কিন্তু পুরস্কার লাভ করিবার পর ঐ স্কুল ছাড়িয়া যাওয়া আমার পক্ষে অন্যায় মনে হইয়াছিল। এই সব কথা ভাবিয়াই আমি পরীক্ষা দিলাম না। আমি আমার নিজ গ্রামে গিয়া দীর্ঘ ছুটী ভোগ করিলাম এবং নিজের ইচ্ছামত গ্রন্থ অধ্যয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষিকার্যের দিকেও মন দিলাম।

 বাল্যকাল হইতেই আমি একটু লাজুক ছিলাম এবং সমবয়সী ছেলেদের সঙ্গে মিশিতাম না। অধ্যয়ন, কৃষিকার্য ও ব্যায়ামই আমার প্রিয় ছিল। আমার বরাবর এইরূপ অভিমত যে, যেসব ছেলেরা সহরে মানুষ, তাহারা সহরের বদভ্যাসগুলির হাত হইতে মুক্ত হইতে পারে না। তাহারা কৃত্রিম আবহাওয়ার মধ্যে লালিত পালিত হয়। ফলে নিজেদের তাহারা