পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ প্রারচ্ছেদ
৩৩

আমি বহু ছাত্রের সংস্পর্শে আসিয়াছি। যাহারা বিদ্যালয়ে পরীক্ষায় খুব কৃতিত্ব দেখাইয়া বৃত্তি প্রভৃতি পাইয়াছিল, তাহাদের অনেকের পরবর্তী জীবন ব্যর্থতার মধ্যে পর্যবসিত হইয়াছে। এমন কি সেকালের প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি প্রাপ্ত (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মান) ছাত্রেরা পর্যন্ত জীবনে বিশেষ কৃতিত্ব দেখাইতে পারেন নাই, তাঁহারা অধিকাংশই বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন হইয়া গিয়াছেন অবশ্য প্রত্যুত্তরে আমাকে বলা হইবে অমুক অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য উচ্চপদ লাভ করিয়াছেন, কিন্তু এইজন একাউণ্টান্ট জেনারেল বড় দরের কেরাণী ভিন্ন আর কিছুই নহেন। নিউটনকে টাকশালের কর্তা করিয়া দিলে হয়ত তাঁহার পদার্থবিদ্যার জ্ঞানের বলে তিনি টাকশালের বহু সংস্কার সাধন করিতে পারিতেন। রাণী অ্যান যদি ‘ক্যালকুলাসের’ আবিষ্কারকর্তাকে রাজস্বসচিব পদে নিযুক্ত করিতেন, তবে কি তিনি যোগ্য নির্বাচন করিতেন? আশঙ্কা হয়, কোষাধ্যক্ষের কর্তারূপে নিউটন ব্যর্থ হইতেন। যাঁহারা গত অর্ধশতাব্দীর মধ্যে কলিকাতা ‘বারে’ আইনজীবীরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, তাঁহাদের ছাত্রজীবন খুব কৃতিত্বপূর্ণ ছিল না। ডবলিউ, সি, ব্যানার্জী, মনোমোহন ঘোষ, তারকনাথ পালিত, সতীশরঞ্জন দাশ এবং আরও অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ কৃতিত্ব না দেখাইলেও, আইনজীবীরূপে সাফল্যলাভ করিয়াছিলেন । প্রথম ভারতীয় 'র‍্যাংলার' এবং প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তিধারী আনন্দমোহন বসু ব্যারিষ্টাররূপে বিশেষ প্রতিষ্ঠালাভ করেন নাই।

 কোন একটি বিষয়ে জীবনব্যাপী নিষ্ঠা ও সাধনাই গৌরবের মূল। যে ছাত্র সকল বিষয়েই ‘ভাল’ সেই সাধারণতঃ পরীক্ষায় প্রথম হয়। কিন্তু কবি পোপ সত্যই বলিয়াছেন— একজন প্রতিভাশালীর পক্ষে একটি বিষয়ই যথেষ্ট।

 যাহা হউক, এ বিষয়ে এখন আমি আর বেশী বলিতে চাই না। আমার পিতা এই সময়ে গুরুতর আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হইতেছিলেন। তাঁহার জমিদারী একটির পর একটি করিয়া বিক্রয় হইতেছিল। মহাজন হইতে দেনদারের অবস্থায় উপনীত হইতে বেশী সময় লাগে না । আমার পক্ষে গর্ব ও আনন্দের কথা এই যে, তাঁহার ঋণ “সম্মানের ঋণ” এবং তিনি তাহা একান্ত সততার সঙ্গে পরিশোধ করিয়াছিলেন।[১] আমার এখনও সেই শোচনীয় দৃশ্য মনে পড়ে—মাতা কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার সম্পত্তির বিক্রয় কবালার দস্তখত করিতেছেন। এই সম্পত্তি তাঁহারই অলঙ্কার বিক্রয় করিয়া কেনা হইয়াছিল এবং


  1. শ্রীযুত অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি নিম্নলিখিত বিষয়টির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছেন (সম্ভবতঃ ইহা অক্ষয়বাবুর নিজের লেখা)।
     “রামতারণ চট্টোপাধ্যায় ইষ্টার্ণ ক্যানেল ডিবিসনের খুলনা জেলায় ডিবিসনাল অফিসার ছিলেন। সুরখালিতে তাঁহার কর্মস্থান ছিল। তিনি খুলনার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, গৌরদাস বসাক, ঈশ্বরচন্দ্র মিত্র এবং মুন্সেফ বলরাম মল্লিক, রাড়লি-কাটিপাড়ার জমিদার হরিশ্চন্দ্র রায় (ডাঃ পি, সি, রায়ের পিতা) প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। প্রথম বয়সে তাঁহার একমাত্র পুত্র অক্ষয়কুমার কলিকাতায় পড়িবার সময়ে হরিশ্চন্দ্রের বাসায় থাকিতেন। হরিশ্চন্দ্রের পরামর্শ ও সহায়তায় সন্দরবন অঞ্চলে বিস্তর জমির মৌরসী ইজারা লইয়াছিলেন; ঐ জমি খুব লাভজনক সম্পত্তি হইয়াছে। হরিশ্চন্দ্রের সাধুতার উপর বিশ্বাস করিয়া রামতারণ হরিশ্চন্দ্রকে অনেক টাকা বিনা দলিলে ধার দিয়াছিলেন। হরিশ্চন্দ্র যোগ্যপুত্রের পিতা ছিলেন।...... যখন তিনি রামতারণের ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা বোধ করিলেন, তখন তিনি নিজের বাড়ীর নিকটবর্তী একটি মূল্যবান সম্পত্তি রামতারণের নামে রেজেস্ট্রী দলিল দ্বারা কবালা করিয়াছিলেন। রামতারণ কিন্তু এবিষয়ে অনেকদিন পর্যন্ত কিছুই জানিতেন না। একদিন রামতারণের সঙ্গে হরিশ্চন্দ্রের সাক্ষাৎ হইলে, হরিশ্চন্দ্র দলিলগুলি রামতারণের হাতে দিয়া হাতে দিরা ঋণের দায় হইতে অব্যাহতি প্রার্থনা করিলেন। (“বংশ পরিচয়”, দ্বিতীয় খণ্ড, ৩৬৬ পৃঃ)