পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
৩৫

পরীক্ষার অনুরূপ ছিল, এবং ইহাতে পাশ করিতে হইলে ল্যাটিন, গ্রীক অথবা সংস্কৃত, ফরাসী বা জার্মান ভাষা জানা অপরিহার্য ছিল। আমি গোপনে এই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা এবং একজন গ্রামসম্পর্কীয় জ্যাঠতুতো ভাই ভিন্ন আর কেহ এ সম্পর্কে সংবাদ জানিতেন না। আমি বিশেষ ভাবে এই সংবাদ গোপন রাখিয়াছিলাম, কেননা পরীক্ষায় ব্যর্থ হইলে, সহাধ্যায়ীগণের শ্লেষ ও বিদ্রুপ সহ্য করিতে হইত। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই গুপ্ত সংবাদ প্রকাশ হইয়া পড়িল; এবং আমার একজন সহপাঠী—(যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় খুব উচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছিলেন) বিদ্রূপ করিয়া বলিলেন, আমার নাম লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেণ্ডারের বিশেষ সংস্করণে বাহির হইবে। পরীক্ষায় সাফল্যলাভের বিশেষ আশা আমি করি নাই এবং পরীক্ষার ফল বাহির হইতে কয়েক মাস অতীত হইল দেখিয়া আমি সকল আশা ত্যাগ করিলাম। একদিন কলেজে পড়া আরম্ভ হইবার পূর্বে ‘ষ্টেটসম্যানের’ একটী প্যারাগ্রাফের প্রতি একজন আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। উহাতে সংবাদ ছিল “গিলক্লাইষ্ট” বৃত্তি পরীক্ষায় দুইজন উত্তীর্ণ হইয়াছে, বাহাদুরজী নামক বোম্বায়ের জনৈক পার্শী এবং আমি। প্রিন্সিপাল একটু পরেই আমাকে ডাকিয়া পাঠাইয়া অভিনন্দিত করিলেন। “হিন্দু পেট্রিয়ট” (তখন কৃষ্ণদাস পাল সম্পাদক) লিখিলেন—আমি ইনষ্টিটিউশনের জন্য নূতন কীর্তি সঞ্চয় করিয়াছি। কিন্তু ঐ কলেজের পড়ার সঙ্গে আমার “গিলক্রাইষ্ট বৃত্তি” পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সম্বন্ধ কতটুকু তাহা আমি ঠিক বুঝিতে পারিলাম না।

 আমার পিতা তখন যশোরে থাকিয়া যশোর ষ্টেশনের নিকটবর্তী ধোপাখোলা পত্তনী তালুক বিক্রয়ের ব্যবস্থা করিতেছিলেন; তাঁহার দেনা শোধের জন্য ইহা প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছিল। তিনি আমার বিলাত যাওয়ার ইচ্ছায় সহজেই সম্মত হইলেন। আমি রাড়ুলিতে আমার একজন দূরসম্পর্কে পড়তুতো ভাইকেও “ষ্টেটসম্যানের” কর্তিত অংশসহ একখানি ইংরাজী চিঠি লিখিলাম। চিঠির শেষে নিম্নলিখিত কথাগুলি ছিল,—উহা এখনও আমার স্মৃতিপটে মুদ্রিত আছে। “আমার মাতাকে এই সংবাদ জানাইবে। তিনি প্রথমে বিলাপ করিবেন, কিন্তু পরে আমার চার বৎসরের বিদেশ বাসের ব্যবস্থায় নিশ্চয়ই সম্মত হইবেন।”

 এখানে বলা যাইতে পারে যে, সেকালে কলেজের শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ইংরাজীতে পত্র লেখা ‘ফ্যাশন’ বলিয়া গণ্য হইত। কিন্তু বর্তমান সময়ে ঐরূপ পত্রলেখকের প্রতি লোকের মনে অবজ্ঞার ভাবই উদয় হইবে, এবং তাহাকে লোকে আত্মম্ভরী বলিবে।

 আমার মাতা আমার বিলাত যাওয়ায় আপত্তি করিলেন না। তিনি আমার পিতার নিকট হইতে উদার ভাব পাইয়াছিলেন এবং বিলাত গেলে জা’ত যাইবে, তখনকার দিনের এই ধারণা তাঁহার মনে স্থান পাইল না। আমি মার নিকট বিদায় লইবার জন্য বাড়ীতে গেলাম। আমি মাকে খুব ভাল বাসিতাম, সুতরাং বিদায় দৃশ্য অত্যন্ত করুণ হইল, এবং আমি বিষণ্ণচিত্তে তাঁহার নিকট হইতে চলিয়া আসিয়াছিলাম। আমি তাঁহাকে এই বলিয়া সান্ত্বনা দিলাম যে, আমি যদি জীবনে সাফল্য লাভ করি, তবে আমি প্রথমেই পারিবারিক সম্পত্তির পুনরুদ্ধার এবং ভদ্রাসন বাটীর সংস্কার করিব। আমি স্বীকার করি যে, আমার মনের আদর্শ তদানীন্তন সামাজিক আবহাওয়ার প্রভাবে সঙ্কীর্ণ ছিল। বিধাতা অন্যরূপ ব্যবস্থা করিলেন এবং পরবর্তী জীবনে আমি এই শিক্ষাই লাভ করিলাম যে, ভূসম্পত্তিতে আবদ্ধ রাখা অপেক্ষা উপার্জিত অর্থ ব্যয় করিবার নানা উৎকৃষ্টতর উপায় আছে।