পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৭১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৩৭

আমার মনে পড়ে, একখানি সিংহলী পত্রে সিংহলের ভূতপূর্ব গবর্নর স্যার উইলিয়ম গ্রেগরীকে ভর্ৎসনা করিয়া লেখা হইয়াছিল যে মিশরী জাতীয়তার নেতা বলিয়া আরবী পাশাকে প্রশংসা করিয়া তিনি (গ্রেগরী) অন্যায় করিয়াছেন।

 কলম্বো হইতে এডেন পর্যন্ত আমার পক্ষে আর একটা অগ্নিপরীক্ষা। এই সময়ে জাহাজ খুব দুলিতেছিল। কখন কখন মনে হইতেছিল—এইবার বুঝি সে সমুদ্রের মধ্যে ডুবিয়া যাইবে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, যখন সমুদ্র শান্ত হইল, তখন অবিলম্বে আমার ‘বিবমিষাও’ দূর হইল। পরে আমার আর মনেই রহিল না যে, আমার কখনও “সমুদ্ররোগ” হইয়াছিল। ষ্টীমার এডেনে পৌঁছিল। আরব-বালকেরা জাহাজের নিকট ভিড় করিয়া চেঁচাইতে লাগিল। “পয়সা দাও—ডুবিব” ইত্যাদি। কেহ কেহ কৌতূহলী হইয়া সমদ্রের জলে সিকি দুয়ানী প্রভৃতি ফেলিয়া দিল—ডুবুরী বালকেরা তৎক্ষণাৎ তাহা জলে ডুবিয়া তুলিয়া আনিল। তীরে উঠিয়া দেখিলাম বাজারের দোকান প্রভৃতি প্রধানত বোম্বাইওয়ালাদের।

 লোহিত সাগর ও সুয়েজখালের মধ্য দিয়া আমাদের জাহাজ নির্বিঘ্নেই পথ অতিক্রম করিল। ইসমালিয়াতে আমরা শুনিয়া আশ্বস্ত হইলাম যে, তীর হইতে আমাদের জাহাজ লক্ষ্য করিয়া কেহ গুলি ছুঁড়িবে না। পোর্ট সৈয়দের অধিবাসীরা মিশ্রজাতি এবং তথাকার মিশরীরা ফরাসী ভাষায় বেশ কথা বলিতেছে। কিন্তু কতকগুলি দৃশ্য দেখিয়া আমাদের বড় ঘৃণা হইল। মাল্টার কথা আমার অল্প অল্প মনে পড়ে এবং জিব্রাল্টারে গিয়া আমাদের জাহাজ শেষবার পথিমধ্যে থামিল। এখানে ফেরীওয়ালারা আঙ্গুর বিক্রী করিতেছিল—দাম প্রতি পাউণ্ড ওজনের এক গোছা এক পেনী। আমরা যখন অন্তরীপ ঘুরিয়া পার হইতেছিলাম তখন শুনিলাম যে, বিশ্বে উপসাগরে জাহাজ চলাচল অত্যন্ত বিপদপূর্ণ। কয়েক বৎসর পরে (১৮৯২) ঐ কোম্পানীরই আর একখানি জাহাজ ঠিক ঐস্থানে এই কাপ্টেন ও বহু যাত্রীসহ ডুবিয়া গিয়াছিল। এই সব যাত্রীদের মধ্যে মুয়র সেন্‌ট্রাল কলেজের অধ্যাপকের পত্নী মিসেস বাউটফ্লাওয়ার এবং তাঁহার সন্তানেরাও ছিলেন। অধ্যাপক বাউটফ্লাওয়ার ‘ষ্টেটস্‌ম্যানের’ মিঃ পল নাইটের ভগ্নীপতি ছিলেন।

 সমুদ্রভ্রমণের সময় ডেক-চেয়ারে শুইয়া নানারূপ দিবাস্বপ্ন দেখা সময় কাটাইবার একটা প্রিয় উপায়।[১] কোন কোন যাত্রী ‘সেলুনের’ লাইব্রেরী হইতে বই লইয়া পড়েন। কিন্তু এইসব বইয়ের অধিকাংশই অসার ও লঘুপাঠ্য। সৌভাগ্যক্রমে আমি নিজে কয়েকখানি ভাল বই সঙ্গে আনিয়াছিলাম। স্মাইলসের “Thrift” আমার প্রিয় সঙ্গী ছিল। বাল্যকাল হইতেই আমি স্বভাবতঃই মিতব্যয়ী ছিলাম— স্মাইল্‌সের’ বই পড়িয়া আমার সেই অভ্যাস দৃঢ়তর হইয়াছিল। স্পেন্‌সারের Introduction to the Study of Sociology আমার মনের উপর খুব প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। কালীপ্রসন্ন ঘোষের ‘প্রভাতচিন্তা’ও আমার সঙ্গে ছিল। রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যজগতে পরিচিত হন নাই। আমার দুই বৎসর পূর্বে তিনি বিলাত গিয়াছিলেন এবং ‘ইউরোপযাত্রীর ডায়েরী’ নামক তাঁহার একখানি প্রকাশিত বহি সঙ্গে ছিল। সেলুনের লাইব্রেরিতে বসওয়েলের “জন্‌সনের জীবনচরিত”ও একখণ্ড ছিল—উহা পড়িয়া আমি মুগ্ধ হইতাম।


  1. যখন ভারত ও বিলাতের মধ্যে যাতায়াতে কয়েকমাস সময় লাগিত, তখন যাত্রীদের পক্ষে সময় কাটানো বড় কষ্টকর হইত। তাঁহারা তখন সময় কাটানোর নানা বিচিত্র উপায় অবলম্বন করিতেন। মেকলে এ সম্বন্ধে একটা সুন্দর বর্ণনা দিয়াছেন; Essay on Warren Hastings দ্রষ্টব্য।