পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৩৮
আত্মচরিত

 আমরা যথাসময়ে গ্রেভসেণ্ডে পৌঁছিলাম। কলিকাতা হইতে গ্রেভসেণ্ডে পৌঁছিতে আমাদের ৩৩ দিন লাগিয়াছিল। সেখান হইতে লণ্ডনের ফেন চার্চ ষ্টীট ষ্টেশনে গেলাম। প্ল্যাটফর্মে জগদীশচন্দ্র বসু এবং সত্যরঞ্জন দাশ (ভারত গবর্ণমেণ্টের ভূতপূর্ব আইন সচিব মিঃ এস, আর, দাশের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা) আমাদের অভ্যর্থনা করিলেন। ডি, এন, রায় এবং আমি প্রায় এক সপ্তাহ তাঁহাদের নিকট থাকিয়া লণ্ডনের অনেক দৃশ্য দেখিলাম। সিংহভ্রাতারা (পরলোকগত কর্ণেল এন, পি, সিংহ আই, এম, এস এবং পরলোকগত লর্ড সিংহ) সৌজন্য সহকারে আমাদের পথপ্রদর্শক ‘পাণ্ডা’ হইলেন।

 টেমস নদীর উপরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানীর জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য আমি আমার সম্মুখে প্রত্যক্ষ দেখিলাম। এই সহর এতদূর ব্যাপিয়া যে, দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইলাম। আমরা রিজেণ্ট পার্কের নিকটে প্লষ্টার রোডে বাসা লইলাম। এই অঞ্চল রাস্তার গাড়ীঘোড়ার কোলাহল হইতে মুক্ত ছিল। এই রাস্তা এবং ইহার নিকটবর্তী রাস্তায় ঠিক একই ধরণে তৈয়ারী বাড়ী, দেখিতে ঠিক একই রকম। ল্যাণ্ডলেডী তোমাকে একটা বাহিরের দরজার চাবি দিবেন। কিন্তু তুমি যদি সহরে নবাগত হও, কিম্বা অনেক রাত্রিতে বাড়ীতে ফিরিবার পথে বাড়ীর নম্বর ভুলিয়া যাও, তাহা হইলে তোমার দুর্দশার শেষ নাই। যদি তোমাকে সহরের কোন দূরবর্তী স্থানে যাইতে হয়, তাহা হইলে তোমাকে Vade-mecum বা লণ্ডনের মানচিত্র দেখিতেই হইবে। এবং তারপর যথাস্থান ঠিক করিয়া নির্দিষ্ট বাস গাড়ী বা ভূ-নিম্নস্থ রেলগাড়ীতে চড়িতে হইবে। নতুবা তোমার গোলকধাঁধায় পড়িয়া হাবডুবু খাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশী। ১৮৮২ সালের প্রথম ভাগেও লণ্ডনে ‘টিউব’ রেল ছিল না। লণ্ডনে যাঁহারা জীবনের অধিকাংশ সময় যাপন করিয়াছেন, এমন কি যাঁহারা সেখানে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন ও লালিতপালিত হইয়াছেন, তাঁহারাও ‘ম্যাপ’ না দেখিয়া লণ্ডনের রাস্তাঘাট ঠিক করিতে পারেন না। সৌভাগ্যক্রমে লণ্ডন পুলিশম্যান সর্বদাই তোমাকে সাহায্য করিতে প্রস্তুত। বিদেশীর প্রতি সে বিশেষরূপ মনোযোগ দেয় ও সৌজন্য প্রদর্শন করে। তাহার পকেটে ম্যাপ থাকে এবং রাস্তাঘাট তাহার নখদর্পণে। তুমি যে সংবাদই চাওনা কেন, তাহার জানা আছে। “এই পথে গিয়া বামদিকে তৃতীয় রাস্তার মোড় ঘুরিয়া সোজা গেলেই আপনি গন্তব্যস্থানে পৌছিবেন”। এই প্রসঙ্গে সেক্সপীয়রের “মার্চেণ্ট অব ভেনিস্” নাটকে ল্যন্সেলট্ গোবের অঞ্চলের রাস্তার বর্ণনা স্বভাবতই আমাদের মনে আসে।

কখন লণ্ডন পুলিশম্যান তোমাকে ঠিক বাস গাড়ীর জন্য অপেক্ষা করিতে বলিবে এবং গাড়ী আসিলে ড্রাইভারকে বলিয়া দিবে তোমাকে যেন ঠিক জায়গায় নামাইয়া দেয়। আমার ছাত্রাবস্থায় লণ্ডনের লোকসংখ্যা ৪০ লক্ষ ছিল—প্রায় স্কটল্যাণ্ড দেশের লোকসংখ্যার সমান। চতুর্থবার (১৯২০) আমি যখন বিলাত যাই, তখন দেখিলাম লণ্ডনের লোকসংখ্যা বাড়িয়া সত্তর লক্ষ হইয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে সহরের আয়তনও বাড়িয়াছে। গ্রেটব্রিটেনের কয়েকটি বন্দর ও পোতাশ্রয়েরও বিরাট উন্নতি হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে লণ্ডন ছাড়া লিভারপুল, গ্লাসগো, গ্রীনক প্রভৃতির নাম করা যাইতে পারে।

 এ বিষয়ে আর বেশী বলিবার দরকার নাই। লণ্ডন সহরে আমার অবস্থিতির প্রথম সপ্তাহেই আমার সঙ্কোচ ও ভয়ের ভাব অনেকটা কাটিয়া গিরাছিল। কোন নূতন স্থানে প্রথম গেলে, অপরিচিত আবহাওয়ার মধ্যে লোকের মনে এইরূপ সঙ্কোচ ও ভয়ের ভাব আসে। আমি লণ্ডন হইতে এডিনবার্গ যাত্রা করিলাম। এডিনবার্গ বহুদিন হইতে বিদ্যাপীঠরূপে বিখ্যাত। মনস্তত্ত্ববিদ্যা এবং চিকিৎসাবিদ্যা বিশেষতঃ শেষোক্ত বিদ্যা শিখিবার জন্য দেশ বিদেশ হইতে ছাত্রেরা এডিনবার্গে আসিত। কয়েকজন বিখ্যাত অধ্যাপক রসায়ন