পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৪০
আত্মচরিত

ছিল। রবিবার দিন আমি পল্লীর মধ্য দিয়া হাঁটিয়া দূরবর্তী পাহাড়ে যাইতাম ও তাহার চূড়ায় উঠিতাম। সেই সময়ে সপ্তাহে ১২ শিলিং ৬ পেন্স দিলে, বেশ পছন্দসই একখানি বসিবার ঘর ও একখানি শয়নঘর পাওয়া যাইত। কয়লার জন্য অতিরিক্ত ভাড়া লাগিত না। কয়লা স্তূপাকার করা থাকিত এবং ইচ্ছামত “ফায়ার প্লেসে”[১] জ্বালানো যাইত। এক পেনীতে ‘পরিজ’ ও মিল্ক দিয়া পুষ্টিকর প্রাতরাশ মিলিত।

 সৌভাগ্যক্রমে আমার “ল্যাণ্ড লেডী” বড় ভাল মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁহার স্বামী ও সন্তানদের লইয়া বাড়ীর পিছনের অংশে থাকিতেন, রাস্তার ধারে সম্মুখের অংশ ভাড়া দিতেন। অন্যান্য স্কচ ‘ল্যাণ্ড লেডী’দের মত তিনি খুব সৎ ছিলেন এবং আমার নিকট সিকি পয়সাও অতিরিক্ত লইতেন না। মোজা প্রভৃতি ধোপাবাড়ী হইতে যতবার ধুইয়া আসিত, ল্যাণ্ড লেডীর মেয়ে প্রত্যেকবার মেরামত করিয়া দিতেন।

 স্কচ ‘ব্রথে’র তুলনা নাই,—ইহা যেমন সস্তা, তেমনি উৎকৃষ্ট। ‘স্কচ ব্রথের’ সম্পর্কে একটি ঘটনা এখনও আমার মনে আছে। আমি একবার বড়দিনের সপ্তাহে সীমান্তে “বারউইক আপন টুইড” সহরে কাটাইয়াছিলাম। নিকটে জেডবার্গে পুরাতন গীর্জার ধ্বংসাবশেষ দেখিতে গেলাম। তুষারাচ্ছন্ন পথে পায়ে হাঁটিয়া গেলাম। অতীতের ধর্মমন্দির দেখিয়া ফিরিবার পথে কোন রেষ্টোরাঁর সন্ধান করিতে লাগিলাম। লোকে সামান্য একখানি ঘর আমাকে দেখাইয়া দিল এবং আমিও কতকটা দ্বিধা সঙ্কুচিত চিত্তে সেখানে প্রবেশ করিলাম। স্থানটী অনাড়ম্বর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমাকে এক প্লেট ‘স্কচ ব্রথ’ ও বড় একখণ্ড রুঢ়ী পরিবেশন করিল। আমার জলযোগের পক্ষে সেই যথেষ্ট। মাত্র এক পেনি মূল্য আমাকে দিতে হইল। আমার সময়ে অতীতের ছাত্রদের সম্বন্ধে অনেক কাহিনী শোনা যাইত। কৃষকের ছেলেরা বাড়ী হইতে হাঁটিয়া, অথবা শকটে চড়িয়া বহুদূরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িতে যাইত। বাড়ী হইতে সঙ্গে ওটমিল (জই), ডিম, মাখন প্রভৃতি আনিত, এবং সেগুলি ফুরাইয়া গেলে, মাঝে মাঝে বাড়ী হইতে পুনর্বার আনাইয়া লইত। কার্লাইলের ‘জীবনী’ যাঁহারা পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন যে, তাঁহার ছাত্রাবস্থায়, এডিনবার্গে ছেলেরা কতদূর মিতব্যয়িতার সঙ্গে জীবনযাপন করিত। গত অর্দ্ধ শতাব্দীর মধ্যে এডিনবার্গে, এমন কি, কলিকাতায় পর্যন্ত ছাত্রজীবনের বহু পরিবর্তন হইয়াছে। সুতরাং সেকালের ছাত্রজীবনের বর্ণনামূলক নিম্নলিখিত উদ্ধৃতাংশ পাঠকের নিকট কৌতূহলপ্রদ বোধ হইতে পারে:—

 “ইংরাজদের নিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন বলিতে বুঝায় বড় বড় ইমারত, সুসজ্জিত গৃহ, বহু টাকার বৃত্তি; ১৯ বৎসর হইতে ২৩ বৎসর বয়স্ক তরুণ ছাত্রগণ; তাহাদের বাড়ী হইতে খরচের জন্য প্রচুর অর্থ আসে—জেমস কার্লাইলের জীবনের কোন এক বৎসরে যাহা সর্বোচ্চ আয় ছিল,—প্রত্যেক ছাত্র তাহার দ্বিগুণ অকাতরে ব্যয় করে। তখনকার দিনে টাইড নদীর উত্তর দিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কোন আর্থিক পুরস্কার, ফেলোসিপ বা বৃত্তির ব্যবস্থা ছিল না—ছিল শুধু বিদ্যা শেখার ব্যবস্থা এবং আত্মত্যাগ ও দারিদ্র্যের ব্রত। এইখানে যাহারা যাইত, তাহাদের অধিকাংশেরই পিতামাতা কার্লাইলের পিতার মতই দরিদ্র ছিল। ছাত্রেরা জানিত কত কষ্ট করিয়া তাহাদের পড়িবার খরচ পিতামাতারা যোগাইতেন। এবং ছাত্রজীবনের সদ্ব্যবহার তথা জ্ঞানার্জনের দৃঢ়সঙ্কল্প লইয়াই তাহারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইত। বৎসরে পাঁচ মাস মাত্র তার ক্লাসে পড়িতে পারিত, বাকী সময় ছেলে পড়াইয়া অথবা গ্রামে ক্ষেতের কাজ করিয়া নিজের পড়িবার ব্যয় সংগ্রহ করিত।


  1. শীতপ্রধান দেশে আগুন জ্বালাইয়া দাখিবার চুল্লীরিশেষ।