পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৭৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৪১

 “সাধারণতঃ, যে সকল ছাত্র তাহাদের পরিবারের মধ্যে সর্বাপেক্ষা মেধাবী হইত এবং যাহাদের উপর পরিবারবর্গের যথেষ্ট আস্থা ছিল, চৌদ্দ বৎসর বয়সে সেই ছাত্রগণ এডিনবার্গ, গ্লাসগো প্রভৃতি সহরে প্রেরিত হইত। বাড়ী হইতে বাহির হইলে পথে অথবা গন্তব্য সহরে তাহাদের দেখাশুনা করিবার কেহ থাকিত না। যানের ভাড়া দিতে পারিত না বলিয়া তাহারা বাড়ী হইতে পায়ে হাঁটিয়া আসিত। কলেজে নিজেরাই নাম ভর্তি করাইত। নিজেরা বাসা ঠিক করিত এবং স্বভাবচরিত্রের জন্য কেবলমাত্র নিজেদের উপরেই নির্ভর করিত। গ্রামের বাড়ী হইতে মাঝে মাঝে লোক আসিয়া ওট মিল (ছাতু), আদা, লবণাক্ত মাখন প্রভৃতি খাদ্যদ্রব্য দিয়া যাইত। কখন কখন কিছু ডিমও দিত। তাহাদের মিতব্যয়িতার গুণে অন্য কোন খাদ্য আর তাহাদের দরকার হইত না। যাহারা খাদ্যদ্রব্য আনিত তাহাদের সঙ্গেই ময়লা পোষাক বাড়ীতে মায়েদের নিকট ধোওয়া ও মেরামতীর জন্য পাঠাইত। বিষাক্ত আমোদ প্রমোদের হাত হইতে দারিদ্র্যই তাহাদিগকে রক্ষা করিত। নিজেদের মধ্যে তাহারা বন্ধুত্ব করিত, পরস্পর পানভোজন ও ভাববিনিময় করিত। কথাবার্তা ও আলোচনার জন্য তাহাদের নিজেদের ক্লাবও থাকিত। “টারম্” শেষ বা কলেজ বন্ধ হইলে তাহারা দল বাঁধিয়া পদব্রজে বাড়ী যাইত, প্রত্যেক জেলারই ২। ৪ জন ছাত্র সেই দলে থাকিত। এই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা সুপরিচিত ছিল, পথে তাহাদের আতিথ্য এবং আদর অভ্যর্থনার অভাব হইত না।

 “স্বাবলম্বনের শিক্ষা হিসাবে, এমন উৎকৃষ্ট শিক্ষালাভের ব্যবস্থা ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে আর দেখা যাইত না।” (Froude’s Life of Carlyle).

 তাহার পরে কয়েকবার আমি এডিনবার্গ ও অন্যান্য স্কচ সহরে গিয়াছি। কিন্তু সহরের জীবন সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। হাইল্যাণ্ড এখন আর শান্তিপূর্ণ নির্জন স্থান নহে। ঔপন্যাসিক স্কটের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা, বিচিত্র পার্বত্য দৃশ্য, রেলওয়ে, মোটরবাস—এই সকলের ফলে দলে দলে ভ্রমণকারীরা এখন ‘হাইল্যাণ্ডে’ যায়, তাহাদের মধ্যে কোটিপতি আমেরিকাবাসীরাও থাকে। তাহারা প্রত্যেক ‘সিজনে’র জন্য বাড়ীভাড়াও করে। স্কচেরা কিন্তু পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সাহসিক ও পরিশ্রমী জাতি। পাটের কল, পাটের ব্যবসা ডাণ্ডিসহরের একচেটিয়া; হুগলী নদীর উপরে প্রায় ৭০। ৮০টী পাটের কল আছে, তাহার অধিকাংশ সুচতুর স্কচদের দ্বারাই পরিচালিত। গ্লাসগো লণ্ডনের পরেই গণনীয় সহর। গত ৫০ বৎসরে স্কটল্যাণ্ডের ঐশ্বর্য প্রভূত পরিমাণে বৃদ্ধি পাইয়াছে। এডিনবার্গ সহরেরও দ্রুত পরিবর্তন হইয়াছে। এডিনবার্গ ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র নহে; কিন্তু প্রচুর পেন্সনভোগী অবসরপ্রাপ্ত অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান এবং বিদেশে প্রভূত ধনসঞ্চয়কারী ব্যবসায়ী প্রভৃতি এডিনবার্গে বাস করাই পছন্দ করেন।

 এডিনবার্গ সহরের চারিদিকে সুন্দর বাসভবন গড়িয়া উঠিতেছে—নূতন সহর, দ্রুত বিস্তৃত হইতেছে। অধিবাসীদের সরল মিতব্যয়ী জীবন অদৃশ্য হইয়াছে এবং বর্তমান যুগের বিলাসপূর্ণ জীবনযাপন প্রণালী গ্রহণ করিতে তাহারা পশ্চাৎপদ হইতেছে না। স্কটল্যাণ্ডের জাতীয় কবি বার্নস বিলাসিতার যে তীব্র নিন্দা করিয়াছিলেন, তাহা তাহারা ভুলিয়া গিয়াছে।

 শীতের সেসনের প্রথমেই আমি ভর্তি হইলাম এবং প্রাথমিক বি, এস্-সি, পরীক্ষার জন্য রসায়নশাস্ত্র, পদার্থবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যা অধ্যয়ন করিতে লাগিলাম। গ্রীষ্ম সেসনের জন্য উদ্ভিদবিদ্যা রহিল, কেন না শরৎকালে ঐ দেশে গাছপালার পত্রপুষ্প সব ঝরিয়া পড়ে। শীতকালে গাছগুলি একেবারে পত্রশূন্য হয় এবং তাহাদের কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখা অনেক সময় তুষারাচ্ছন্ন থাকে। অধ্যাপক টেইট পদার্থবিদ্যার মূল সূত্র চমৎকার বুঝাইতেন।