পাতা:আত্মচরিত (প্রফুল্লচন্দ্র রায়).djvu/৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
৪৩

বৎসর পরেও মনে পড়িতেছে। আমি জার্মান ভাষা মোটামুটী শিখিলাম, তাহার ফলে উক্ত ভাষায় লিখিত রসায়ন শাস্ত্র বুঝিতে পারিতাম। আমার একজন সহাধ্যায়ী ছিলেন জেমস ওয়াকার (পরে স্যার জেমস ওয়াকার)। তিনি ডাণ্ডীর অধিবাসী ছিলেন। ক্রাম ব্রাউন অবসর গ্রহণ করিলে, ওয়াকারই ঐ পদ লাভ করেন। আমার সমসাময়িক ‘জুনিয়র’ ছাত্র আর দুইজন খ্যাতি লাভ করিয়াছিলেন। একজন আলেকজাণ্ডার স্মিথ, ইনি পরে চিকাগো ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হন। অন্য একজন হিউ মার্শাল, ইনি ‘কোবাল্ট অ্যালাম’ আবিষ্কার এবং ‘পারসালফারিকা অ্যাসিড’ সম্বন্ধে গবেষণা করিবার জন্য বিখ্যাত। মার্শাল মাত্র ৪৫ বৎসর (১৯১৩ খৃঃ) বয়সে মারা যান। ৫৭ বৎসর বয়সে (১৯২২ খৃঃ) স্মিথের মৃত্যু হয়।[]

 আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করিতেছিলাম তখন এমন একটি ঘটনা ঘটে, যাহার দ্বারা আমার সমগ্র ভবিষ্যৎ জীবন প্রভাবাম্বিত হয়। সতরাং ঐ ঘটনাটি এখানে উল্লেখযোগ্য। স্যার ষ্ট্যাফোর্ড নর্থকোট ১৮৬৭-৬৮ সালে ভারতসচিব ছিলেন। ইনিই পরে লর্ড ইড্‌স্‌লি উপাধি লাভ করেন। ১৮৮৫ সালে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের লর্ড রেক্টাররূপে ইনি ঘোষণা করেন যে “সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বে ও পরে ভারতের অবস্থা” সম্বন্ধে সর্বোৎকৃষ্ট প্রবন্ধের জন্য একটী পুরস্কার দেওয়া হইবে। তখন আমি লেবরীটরীতে বিশেষ পরিশ্রম করিতেছিলাম এবং বি, এস্-সি, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম। তৎসত্ত্বেও আমি প্রবন্ধপ্রতিযোগিতায় যোগ দিলাম। আমার ইতিহাসচর্চার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি পুনরায় জাগ্রত হইল এবং কিছুকালের জন্য রসায়ন শাস্ত্রের স্থান অধিকার করিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরী হইতে আমি ভারত সম্বন্ধে বহু গ্রন্থ আনিয়া অধ্যয়ন করিতে লাগিলাম। রুসেলের “L’Inde des Rajas”, Lanoye’s “L’Inde contemporaine”, “Revue des deux mondes” এ ভারত সম্বন্ধে প্রবন্ধাবলী প্রভৃতি ফরাসী ভাষায় লিখিত গ্রন্থও এই উদ্দেশ্যে পড়িলাম। আমি শীঘ্রই দেখিলাম যে বাজেট আলোচনা এবং রাজনীতি, বিনিময়নীতি প্রভৃতি বুঝিতে হইলে অর্থনীতি (Political Economy) কিছু জানা দরকার। আমি সেইজন্য ফসেটের Political Economy এবং Essays on Indian Finance গ্রন্থ পড়িলাম। এই অন্ধ অর্থনীতিবিৎ হ্যাকনীর প্রতিনিধিরূপে পার্লামেণ্টে প্রবেশ করেন এবং ভারতীয় সমস্যা সম্বন্ধে তাঁহার গভীর জ্ঞানের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন। বাল্যকালে “হিন্দু পেট্রিয়টে” আমি পড়িয়াছিলাম, মিঃ ফসেট পার্লামেণ্টে ভারতের বহু উপকার করিয়া ভারতবাসীদের ভালবাসা লাভ করেন। সাধারণের নিকট হইতে তাঁহার ভারতপ্রীতির জন্য “Member for India” বা ‘ভারতের প্রতিনিধি’ এই আখ্যাও তিনি লাভ করেন। এই বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে ভারত সম্বন্ধে বহু প্রামাণিক গ্রন্থই আমি পড়িয়া ফেলিয়াছিলাম। “ফর্ট নাইট্‌লি রিভিউ”, “কনটেম্‌পোরারি রিভিউ”, ‘নাইনটিথ সেঞ্চুরী’ প্রভৃতি মাসিকপত্রে প্রকাশিত ভারত সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ আমার দৃষ্টি এড়াইত না। কতকগুলি প্রধান প্রধান ঐতিহাসিক সমস্যা


  1. এস্থলে একটা কৌতুকাবহ ঘটনার উল্লেখ করিতে বাধ্য হইলাম। গত বৎসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গবর্ণর স্যার জন এভার্সন ও আমাকে (অন্যান্যদের মধ্যে) সম্মান সূচক উপাধি দেন। আমি ভাইস্‌চান্‌সেলরের At home তে স্যার জনের ঠিক পাশেই উপবেশন করি এবং তাঁহাকে উদ্দেশ করিয়া বলিলাম, “আজ আমরা উভয়েই fellow graduate অর্থাৎ একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী”, তাহাতে স্যার জন বলেন, ইহা ঠিক নয়; আমরা বহুপূর্বেই fellow graduates অর্থাৎ তিনিও আমার অনেক পরে এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঐ টেট ও ক্রাম ব্রাউনএর নিকট অধ্যয়ন করেন এবং Hope Prize (রসায়ন বিদ্যার) লাভ করেন।