ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
গৃহে প্রত্যাগমন—প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক নিযুক্ত
ঠিক ছয় বৎসর পরে ১৮৮৮ সালের আগষ্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি কলিকাতা পৌছিলাম। এডিনবার্গ থাকিবার সময়ে আমি আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে ১৫ দিন অন্তর পোস্টকার্ডে একখানি করিয়া পত্র লিখিতাম (জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ডায়মণ্ডহারবারের উকীল ছিলেন)। তিনি বাড়ীতে পিতা মাতাকে আমার খবর লিখিয়া পাঠাইতেন। আমি তাঁহাদিগকে আমার আসিবার নির্দিষ্ট তারিখ, ষ্টিমারের নাম প্রভৃতি জানাই নাই, কেন না আমার জন্য যে তাঁহারা অনাবশ্যক ব্যয় বহন করিবেন, ইহা আমার ইচ্ছা ছিল না। আমার মনে মনে বরাবরই আশঙ্কা ছিল, পিতার আর্থিক অবস্থা পূর্বাপেক্ষা আরও বেশী শোচনীয় হইয়াছে। আমি আমার লগেজ ক্যাবিনে রাখিয়া আসিলাম এবং জাহাজের ‘হেড পার্সারের’ নিকট আট টাকা ধার করিলাম, কেন না আমার তহবিলে এক পয়সাও ছিল না। কলিকাতায় আমার অনেক বন্ধু ছিলেন, আমি তাঁহাদের একজনের বাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। আমার প্রথম কাজই হইল—ধুতি ও চাদর ধার করিয়া লইয়া পরা এবং বিদেশী পরিচ্ছদ ত্যাগ করা। দুই একদিন কলিকাতায় থাকিয়া আমি স্বগ্রামে গেলাম। শিয়ালদহ হইতে খুলনা এই আমি প্রথম রেলগাড়ীতে ভ্রমণ করিলাম। ১৮৮২ সালে যখন আমি বিলাত যাত্রা করি, তখন ঐ রেলপথের জন্য জরিপ প্রভৃতি হইতেছিল এবং প্রসিদ্ধ ধনী রথচাইল্ড উহার মূলধন জোগাইবেন বলিয়া শুনিয়াছিলাম। আমি আর এখন যশোরবাসী নহি, খুলনাবাসী। যশোর, ২৪ পরগণা এবং বরিশালের কিছু কিছু অংশ লইয়া নূতন খুলনা জেলা গঠিত হইয়াছিল।
মাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইলে তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। আমার কনিষ্ঠা সহোদরা আমাকে অভ্যর্থনা করিবার জন্য আর ইহজগতে উপস্থিত ছিল না। এইখানে আমি একটি ঘটনা বলিব, যাহার মূল্য পাঠকগণ নিজেরাই বিচার করিবেন। ইংরাজীতে একটা কথা আছে—‘ভবিষ্যতের ঘটনা বর্তমানের উপর ছায়াপাত করে’। আমার বর্ণিত ঘটনাকে তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপও গণ্য করা যাইতে পারে। এডিনবার্গে একদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গিবার পূর্বে আমি অবিকল পূর্বোক্ত ঘটনা (আমার গৃহে প্রত্যাবর্তন এবং কনিষ্ঠা ভগ্নীর জন্য মাতার বিলাপ) স্বপ্নে দেখিয়াছিলাম। দুঃখের বিষয়, আমি স্বপ্নদর্শনের তারিখ লিখিয়া রাখি নাই। রাখিলে অতি-প্রাকৃত দর্শন সম্বন্ধে আর একটা প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারিতাম।[১]
কয়েকদিন বাড়ীতে থাকিয়া আমি কলিকাতায় চলিয়া আসিলাম এবং আমার বন্ধু ডাঃ অমূল্যচরণ বসু এম. বি.-এর গৃহে উঠিলাম। ইঁহার সম্বন্ধে অনেক কথা পরে বলিব। আমি এখন বঙ্গীর শিক্ষাবিভাগে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপকের পদ পাইবার জন্য ব্যগ্র হইলাম এবং সেই উদ্দেশ্যে ক্রফ্ট এবং পেড্লারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিলাম। আমি দার্জিলিং-এ গিয়া লেঃ গবর্ণর স্যার স্টুয়ার্ট বেলীর সঙ্গেও সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলাম।
- ↑ ইটালীর স্বাধীনতার যোদ্ধা গ্যারিবল্ডী আমেরিকা থাকিবার সময় তাঁহার মাতার মৃত্যু সম্বন্ধে এইরূপ অতি-প্রাকৃত স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন।